গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে, আজারবাইজানের সামরিক বাহিনী আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা ছোট অঞ্চল নাগোর্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এতে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানের মানুষ খুবই বিচলিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। হাজার হাজার জাতিগত আর্মেনীয় তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে এই পাহাড়ি ছিটমহলটি থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার মর্মান্তিক ছবিগুলো এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষের সহানুভূতি অর্জন করছে। এগুলোতে আরেকটি বড় মানবিক বিপর্যয়ের ছবি দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে।
বাস্তব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে, কারাবাখে বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকারের পতন মানে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের বিজয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার জাতিগত আর্মেনীয়র প্রতিনিধিত্বকারী তিন দশকের পুরানো এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকার আর্মেনিয়ার জন্য রাজনৈতিক বোঝা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এটি এই অঞ্চলে শান্তি ও সহযোগিতার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে আর্মেনিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার শক্তিশালী মিত্র এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলটির রক্ষক হিসেবেই ছিল। ২০২০ সালে রাশিয়া এই এলাকায় শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে নিশ্চিত করেছিল যেন আর্মেনিয়ার সাথে সংযুক্ত ছিটমহলের একমাত্র রাস্তাটি খোলা থাকে।
রাশিয়া মূলত আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলটিকে ব্যবহার করেছে। জর্জিয়া, ইউক্রেন ও মালডোভাসহ সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেশগুলোর জন্যও এটি পরীক্ষিত রুশ কৌশল। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘর্ষ জিউয়ে রেখে রাশিয়া চেয়েছিল ইয়েরেভান (আর্মেনিয়ার রাজধানী) বা বাকু (আজারবাইজানের রাজধানী) তার নিয়ন্ত্রণে থাকুন। তারা যদি তা না করতো তবে মস্কো এই অঞ্চলের তার সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি বা হ্রাস করার হুমকি দিতো। আর একারণেই উভয় দেশ মস্কোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
এদিকে কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিকোল পাশিনিয়ানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতো, যার দরুন আর্মেনিয়া কখনোই এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। এ ছাড়াও পাশিনিয়ানকে দিয়ে আজারবাইজানের ওপর কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ানোর জন্য, কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতো। কারাবাখের সবচেয়ে শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিবিদ রুবেন ভারদানিয়ান। তিনি একজন রাশিয়ান বংশোদ্ভূত ধনকুবের এবং পুতিনের সাবেক সহযোগী। যিনি ট্রোইকা ডায়ালগ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে রাশিয়ান অলিগার্কদের ৪.৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করতে সাহায্য করেছিলেন। পরে ব্যাঙ্কটি রাশিয়ার এসবারব্যাংক (Sberbank) এর অংশ হয়ে ওঠে। এদিকে, গত বছর মার্কিন কংগ্রেসের ৪৬ জন সদস্য পুতিন জবাবদিহি আইন (পুতিন অ্যাকাউন্টেবিলিটি এক্ট) গঠন করে ভারদানিয়ানসহ অন্যান্য “ক্লেপ্টোক্র্যাট ও রাশিয়ান ফেডারেশনের সিনিয়র রাজনৈতিক ব্যক্তিদের” ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেন।
বলাবাহুল্যা, কারাবাখের কর্মকর্তা আরাইক হারুতুনিয়ান আর্মেনিয়ায় না গিয়ে প্রায়ই রাশিয়ার সামরিক সাহায্য চাইতেন। পুতিনও তাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক ছিলেন। পরে আর্টসখ প্রতিরক্ষা বাহিনী নামে পরিচিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকারের সামরিক বাহিনী রাশিয়ার কাছ থেকে উচ্চ প্রযুক্তির কর্নেট গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র সহ উন্নত অস্ত্র সহায়তা পায়।
তবে, নিকোল পাশিনিয়ান (আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী) এই ধরনের আঞ্চলিক অস্থিরতার বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি কারাবাখকে এ বছরের শুরুতে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকার করেন। এবং আজারবাইজানের সঙ্গে সংঘাতে তিনি আর্মেনিয়াকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, আর্মেনিয়াকে “সংঘাত মুক্ত” রাখা দেশের স্বাধীনতা ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য। প্রায় তিন দশকের পুরনো কারাবাখ যুদ্ধের অবসানের পরে, আর্মেনিয়া ও এর চার প্রতিবেশীর মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ থাকা উচিত নয়।
সদ্য পুনরুদ্ধার করা ‘শান্তি’ ইয়েরেভানকে (আর্মেনিয়ার রাজধানী) আজারবাইজান এবং তুরস্কের সাথে সম্পর্কিত হতে সহায়তা করবে। এই জোট পরে পাশ্চাত্যের সাথে আর্মেনিয়ার সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে নিকোল পাশিনিয়াকে সহায়তা করতে পারবে।
কারাবাখের পতনের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর থেকে, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের বিশেষজ্ঞরা এর সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধাগুলি তুলে ধরতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে ইয়েরেভানের প্রতিবেশী আজারবাইজান ও তুরস্কের সাথে অর্থনৈতিকভাবে জোট করা সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। আর্মেনিয়া এই মধ্য করিডোর থেকে উপকৃত হওয়ার অবস্থায় থাকবে। একটি সম্ভাব্য লাভজনক বাণিজ্য রুট, যা রাশিয়া ও ইরান উভয়কে এড়িয়ে চীনকে ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করেছে। বস্তুত, এটি আর্মেনীয় পণ্যগুলোকে সহজে ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ করতে দেবে, ইয়েরেভানকে অর্থনৈতিকভাবে ইরান এবং রাশিয়া থেকে দূরে রাখতেও সহয়তা করবে।
তবে, আঞ্চলিক সহযোগিতা তখনই সম্ভব হবে যখন আজারবাইজান শান্তিপূর্ণ উপায়ে কারাবাখের জাতিগত আর্মেনীয়দের একীভূত করার ব্যাপারে আন্তরিক হবে। আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলেও কারাবাখের অনেক আর্মেনীয় বৈধভাবে আর্মেনিয়ায় পালিয়ে গেছে কারণ তারা আজারবাইজানের প্রতিশ্রতিতে বিশ্বাস করে না। আর্মেনীয় কর্মকর্তাদের মতে, ছিটমহলের প্রায় ৮০% আর্মেনীয় চলে গেছে। তিন দশকের জাতিগত যুদ্ধের পরে- যা গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। আজারবাইজান কর্তৃপক্ষের জন্য সহাবস্থানের পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে অবশিষ্ট জাতিগত আর্মেনীয়দের আস্থা অর্জন করা জরুরি।
তবে সহাবস্থানের পরিস্থিতি তৈরি করা খুব কঠিন। সবচেয়ে বড় দুই বাধা রাশিয়া ও ইরান। উভয়েই আজারবাইজান ও আর্মেনিয়াকে চাপে রাখতে কারাবাখের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে, রুশ মিডিয়া নিকোল পাশিনিয়ানের বিরুদ্ধে একটি উগ্র প্রচারণা চালিয়েছে, এই মিথ ছড়িয়েছে যে তিনি রাশিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে কারাবাখ হারিয়েছেন। এর জবাবে, কারাবাখের প্রাক্তন নেতা হারুতুনিয়ান আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে হাইব্রিড যুদ্ধ চালানোর অভিযোগে রাশিয়ান মিডিয়াকে অভিযুক্ত করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
রুশ কর্মকর্তারাও চুপ থাকেননি। ক্ষয়ক্ষতির জন্য রাশিয়াকে দোষারোপ করার জবাবে, রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ নিকোল পাশিনিয়ানকে হুমকি দিয়ে বলেন, “আমরা দেখব তার জন্য কী ধরনের ভাগ্য অপেক্ষা করছে”। এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেছে যে, আর্মেনীয় সরকার দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং “পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জিম্মি” হয়ে গেছে। এর তিনদিন পরে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, আর্মেনীয় কর্মকর্তারা পশ্চিমের দিকে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী থাকলেও, “ককেশাসে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উপেক্ষা করা যাবে না।”
এই মনোভাব কার্যকর হতে পারে। তাছাড়া, আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে ক্রেমলিন-সমর্থিত অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয় দেশের মিডিয়ার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। আর্মেনীয় সরকার সক্রিয়ভাবে দেশের মধ্যে ওয়াগনার সৈন্যদের উপস্থিতি খতিয়ে দেখছে, যারা শাসক পরিবর্তনের আয়োজন করছে বলে জানা গেছে। রাশিয়ান দ্যুমার স্পিকার ইভজেনি ফেডোরভ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, তার দেশ “আর্মেনিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে” এবং “গভর্নর বা অন্য কিছু” স্থাপন করবে। তবে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দাবি অস্বীকার করেছে।
নিকোল পাশিনিয়ান যদি প্রতিবাদকারীদের উত্থাপিত চ্যালেঞ্জ ও ক্রেমলিনের ষড়যন্ত্র উভয়ই প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন তবে আর্মেনিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে যুথবদ্ধভাবে একটি প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে পারে। কিন্তু যদি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তবে এটি কেবল আর্মেনিয়ার সার্বভৌমত্বের জন্যই নয়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অর্জনের সম্ভাবনার জন্যও তা বড় একটি ধাক্কায় পরিণত হবে।
সূত্র : নিউজউইক
জোসেফ এপস্টেইন এনডাউমেন্ট অফ মিডল ইস্ট ট্রুথ (EMET) এ আইনসভার ফেলো হিসাবে কাজ করেন।
Discussion about this post