কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার শহরতলীর একটি চায়ের দোকান। দোকানটির বয়স আনুমানিক ১৭ থেকে ১৮ বছর। এই দোকানে চা, পান ও বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছেন আজহার, রসুল, শফিরা। আবার শিশু-কিশোর থেকে পরিণত যুবকে পরিণত হয়েছেন জাফর-জহিররা। এখন তাদের কণ্ঠ তেজ বাড়ায় চায়ের চুলোয়। তাদের হাতেই সিগারেটটা আগে বাড়িয়ে দিতে ব্যস্ত দোকানি। কিন্তু আলাপে সেই তেজ কই? যেই তেজের আষাঢ়ে গল্পে একসময় সকাল-বিকাল ক্ষমতা হারাতেন হাসিনা-খালেদা। তথ্যের উৎস না থাকলেও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজের মতো গল্প বানাতেন তারা।
এভাবেই গণতন্ত্রের দেশে, চায়ের কাপে ঝড় তুলে কেটে যেত তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখন সেই তেজ কোথায়? সেই তেজ খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম আরও কিছু চায়ের দোকান ও গ্রামের আড্ডা ঘুরে। না, সত্যিই সেই তেজের গল্প হারিয়ে গেছে গ্রাম থেকেও। গ্রামের মানুষের স্বতন্ত্র-স্বাধীন জীবনও এখন রাজধানীর রাজনীতির ভয়ে চুপসে গেছে। তারা এখন আর কারো আশার বাণীতে বিশ্বাস করে না, তারা কারো অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলে নিজের পরিবারের ক্ষতি ডেকে আনতে চায় না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে দেশ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের জন্য এটি সেই সুবর্ণ মুহূর্ত, যখন সে তার শাসক নির্বাচনের সুযোগ পায়। ভোটের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনার বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি ভালো লাগা খারাপ লাগা প্রকাশের সুযোগ মেলে রাষ্ট্রের মালিকের। এতো বড় একটা উৎসব দোড়গোড়ায়; অথচ কান পাতলেই শোনা যায়, চোখ খুললেই দেখা যায়, উৎসব নেই। চারিদিকে বাজার বাড়ছে জ্বরা-চিন্তার, দুর্ভাবনার! নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের মতোই ঊর্ধ্বমুখী তার পথচলা।
স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দী ধরে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা, তাদের মনে এই বিশ্বাস প্রবল করে তুলেছে, কোনোকিছুই বদলানোর নয়! তাকে শুধু নিজের চিন্তাই করতে হবে, রাষ্ট্রের চিন্তায় তার পেট ভরবে না। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মুখে তাকে ঘুরেফিরে সেই রাষ্ট্রের পরিচালকদের দিকেই তাকাতে হয়। সে জানে, রাষ্ট্র তাকে দুর্ভোগে রাখতে পারে কিংবা ভালো রাখারও সুযোগ আছে। কিন্তু সে ধরেই নিয়েছে রাষ্ট্র তাকে শুধু দুর্ভোগই দিতে পারে। রাষ্ট্র শুধু তার চলার পথ আটকে দাঁড়াতে পারে কিন্তু কোনো পথে এক পা এগিয়ে দেবে না। অথচ এই মানুষগুলোই ওই দোকানের জন্মলগ্নে বিশ্বাস রাখতেন তাদের হাসিনা কিংবা তাদের খালেদা ক্ষমতায় এলেই তাদের দুঃখ-কষ্ট ঘুঁচে যাবে। জিনিসপত্রের দাম সকাল-বিকাল বাড়বে না। থানা-আদালতে সুবিচার মিলবে। তার সন্তান চাকরি পাবে। কোন মন্ত্রে বদলে গেল এখানকার মানুষগুলো? কোন মন্ত্র বলে তারাও কষ্টকে চাপা দেওয়া শিখে গেল? নাকি দীর্ঘ ১৫ বছরের একদলীয় শাসনে তারা তাদের ভোটাধিকারের কথা ভুলতে বসেছে? ভুলবেই না কেন, যে চেয়ারম্যান তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন তাকেও তো নির্বাচিত করার সুযোগ হারিয়েছে তারা। মানুষের এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল ‘স্টকহোম সিনড্রম’ নামে এক তত্ত্ব।
১৯৭৩ সালে ২৩ আগস্ট সুইডেনের একটি বড় ব্যাংক ক্রেডিটবাংকেনে ডাকাতি করতে যান প্যারোলে মুক্তি পাওয়া জ্যঁ এরিক-ওলসন। ব্যাংকের চার কর্মচারীকে জিম্মি করে একটি ভল্টে আটকে রাখা হয়। জিম্মিদের না মারার শর্ত হিসেবে ওলসন কারাগার থেকে তার আরেক বন্ধু ক্লার্ক ওলফসনকেও মুক্ত করে আনেন। শেষপর্যন্ত ডাকাতি সফল হয়নি। ছয়দিনের জিম্মিদশা কাটিয়ে ২৮ আগস্ট পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন দুই ডাকাত। তবে এই ছয় দিনে জিম্মিদের হত্যার হুমকি, পুলিশের ওপর গুলিসহ নানা ধরনের অপকর্মই করেছেন তারা। মজার ব্যাপার হলো, মুক্তি পাওয়ার পর চার জিম্মির কেউই ডাকাতদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি। তাদের দাবি, ডাকাতদের সঙ্গে তারা খুব ভালো ছিলেন, বরং পুলিশের আচরণে তাদের ভয় লাগছিল। এমনকি ডাকাতদের শাস্তি থেকে বাঁচাতে অর্থ সংগ্রহও শুরু করেন জিম্মিরা। জিম্মিদের এমন আচরণে বিপদে পড়ে যায় পুলিশ ও মামলার আইনজীবীরা। জিম্মিদের এমন আচরণ বিশ্লেষণে তারা দ্বারস্থ হয় নিলস বেয়েরোট নামে এক মনোবিদের। তিনিই এই পরিস্থিতির নাম দেন, স্টকহোম সিনড্রোম। ডাকাত ওলসন পরে বলেন, জিম্মিরা কথা না শুনলে তিনি ঠিকই গুলি করে বসতেন, কিন্তু কেন জানি তিনি যাই বলছিলেন, জিম্মিরা তাতেই সায় দিচ্ছিল, এমনকি নিজে থেকে সহায়তাও করছিল। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার রেশ পণবন্দীর মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং এই ভাবনা দিন, সপ্তাহ, মাস, এমনকি কয়েক বছর ধরে বন্দী বা নির্যাতনের পরেও বিকাশ লাভ করতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষ তাদের বিপজ্জ্বনক পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে কোনো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাহায্য করতে আসলে, উল্টো তাদের ওপরেই বিরক্তি প্রকাশ করতে পারে অপহৃত ব্যক্তিরা।
যদিও এসব পরিবর্তন সাধারণত বন্দী ও নির্যাতিত মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন গণতন্ত্র চর্চা থেকে দূরে থাকা মানুষের মনেও কী এমন কোনো পরিবর্তন হয়, সেটাও গবেষণার একটা দীর্ঘবিষয় হতে পারে।
সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থসম্পদ ও ভোগবিলাস সম্পর্কে যতখানি সচেতন, ঠিক ততটাই অসচেতন কিংবা উদাসীন তার চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে। জলবায়ু পরিবর্তনে তার জন্মভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কি না, তার দেশ স্বৈরশাসনের পথে আগাচ্ছে কি না। যে দেশে তার পরবর্তী প্রজন্ম বসবাস করবে, তার নিরাপত্তা ঠিক থাকছে কি না। তার দেশে শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থা ঠিক আছে কি না; কোনোকিছুই আর তাকে ছুঁয়ে যায় না। এসব আলোচনা যেন নিতান্তই অর্থহীন প্রলাপ মাত্র। যে কোনো উপায়ে নিজের জন্য টাকা লাগবে তার । আর কারো কারো ক্ষেত্রে যেন তা লাগবে না!
Discussion about this post