‘তলে তলে আপোস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে, আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরাও আছি। শত্রুতা কারও সঙ্গে নেই, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে ভারসাম্য করে ফেলেছেন। আর কোনো চিন্তা নেই। যথাসময়ে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন।’ এই বক্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের। এ বক্তব্যের পর বেশ কিছু বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রশ্ন হলো, আমেরিকার সাথে আওয়ামী লীগ আপোস করলো কিসের বিনিময়ে? দিল্লি ও আমেরিকা কোনো দলের সাথে আপোস করলে বা তাদেরকে সাপোর্ট করলে তারা বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করতে পারে বা ক্ষমতায় থাকতে পারে কি? দিল্লি ও আমেরিকার সাথে আপোস করেই কি ক্ষমতায় থাকা যায়? সেতুমন্ত্রী কি এটা বলতে চাচ্ছেন যে, দিল্লি আর আমেরিকার সাথে আপোস হয়ে যাওয়ার পর ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো আরো একটা নির্বাচন করে এই দেশে ক্ষমতায় থাকতে কোনো সমস্যা হবে না? ২০১৪ ও ১৮’র নির্বাচনের পর কি তাহলে আমেরিকা ও দিল্লির সাথে আপোস করেই ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামী লীগ? গণতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ, কিন্তু বাংলাদেশ ক্ষমতার উৎস কি দিল্লি বা আমেরিকা? ওবায়দুল কাদের কি বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের প্রতি অন্য দেশের প্রভাব খাটানোকে মেনে নিলেন? ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা বললে কি ভুল হবে?
এই প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে এবং এই বিষয়গুলো নিয়ে অবশ্যই জবাবদিহি করা উচিত। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মতোই প্রশ্নগুলো করার কেউ নেই। বাংলাদেশে যে সব সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন তারা কি এই প্রশ্নগুলো করবেন? না কি তারাও আপোস হয়ে যাওয়ার আনন্দে বগল বাজাবেন?
মাত্র কয়েক মাস আগেই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সেন্টমার্টিন বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা। আমার হাত থেকে এদেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না। ওই গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে আমিও ২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।’ (২১ জুন ২০২৩, কালের কণ্ঠ)
এর আগে যুক্তরাজ্য সফরের সময় বিবিসির ইয়ালদা হাকিমের সাথে একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলেই বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। হয়তো তারা আমার কাজ অব্যাহত থাকুক তা চায় না, আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা হয়তো গ্রহণ করতে পারছে না। এটা আমার অনুভূতি।’ (১৬ মে ২০২৩, বিবিসি বাংলা)
বর্তমান সরকারের জোটসঙ্গী বামপন্থী দল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) পক্ষ থেকেও সংসদ অধিবেশনের বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ চায়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বিভিন্ন নেতৃত্বের পক্ষ থেকেও এমন দাবি বারবার করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দেয়া হয়ে যে, তারা বাংলাদেশের কাছে এমন কোনো দাবি করেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেতুমন্ত্রী যখন বললেন, আমেরিকা ও দিল্লির সাথে তলে তলে আপোস হয়ে গেছে তখন কি এটা বুঝে নেয়া যায় যে, এর আগে প্রধানমন্ত্রী যে বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করে তার আপোসহীন চরিত্রের জানান দিয়েছেন সেই ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও দিল্লির সাথে আপোস করে ফেলেছেন? সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ দেয়া নিয়ে কি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো আপোস হলো? এবার কি যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন লিজ পাচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘হয়তো তারা আমার কাজ অব্যাহত থাকুক তা চায় না, আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা হয়তো গ্রহণ করতে পারছে না। এটা আমার অনুভূতি।’ তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কি এমন আপোস হলো যে, আগামী দিনে বর্তমান সরকারে যে ‘উন্নয়ন’ সেটা আর বজায় থাকবে না? কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় না এই উন্নয়ন অব্যাহত থাকুক। যুক্তরাষ্ট্র যদি না চায় তাহলে এখন কি উন্নয়নমূলক কাজ আর করা হবে না এমন বিষয়ে আপোস হলো?
ওবায়দুল কাদেরে বক্তব্যের পর এই প্রশ্নগুলো ওঠা খুবই স্বাভাবিক। এবং এসব বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট জবাব থাকাও জরুরি।
এখন আসি ভিন্ন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের বামপন্থী মহল ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী মহল আরো স্পষ্ট করে বললে আওয়ামীপন্থী বাম মহল আওয়ামী লীগকে একটি প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, দেশপ্রেমি, মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র স্বপক্ষ শক্তির রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার করার দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও দলটির সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপোসহীন একটি ইমেজ তৈরির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা যে কেবলই প্রোপাগান্ডা সেই সত্যের স্বীকারোক্তি দিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অন্যদিকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগও এই দেশের মানুষের ওপরে যে আস্থাশীল না এটাও ওবায়দুল কাদের বক্তব্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
‘আওয়ামী লীগ একটি ভারতপন্থী রাজনৈতিক দল’ বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর এই প্রচারণাও সত্যই প্রমাণ করেছেন ওবায়দুল কাদের।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের একটি মাল্টিক্লাস পার্টি। দলটি একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় বাদে কখনোই আমেরিকার সাথে মুখোমুখি হয়নি, এমনকি কখনোই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রও এই দলটির ছিল না। ১৯৫৭ সালে এই দলটি ভাঙে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যান এবং ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ নামে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ছিলেন মার্কিনপন্থী। তখন সোভিয়েত রাশিয়ার মদদে মিশরের প্রধানমন্ত্রী জামাল আবদেল নাসেরে নেতৃত্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন নামে একটি আন্তর্জাতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া বলয়ের বাইরের দেশগুলো নিয়ে এই জোট গঠিত হয়। ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশ নেয়, অন্যদিকে পাকিস্তান অংশ নেয় আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটে। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে মার্কিন জোটে অন্তর্ভুক্ত করার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর কেন্দ্রে দলটির নেতা সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। দলের সভাপতির এমন ভূমিকার জন্য সোহরাওয়ার্দী চাপে পড়েন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন আয়োজন করেন। সেখানে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণের দাবি জানান, একই সাথে আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত পশ্চিমা জোটের কড়া সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা মওলানার এই প্রস্তাবের বিপক্ষ অবস্থান নেয়। সে সময় মানিক মিয়া সম্পাদিত ইত্তেফাক পত্রিকা মওলানা ভাসানীর চরিত্র উদ্ধার করে একপেশে সংবাদ প্রকাশ ও সম্পাদকীয় লিখতে থাকে। এই ইত্তেফাক পত্রিকা মওলানা ভাসানীই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং মানিক মিয়াকে তিনিই দায়িত্ব দেন। মানিক মিয়া ছিলেন আওয়ামীপন্থী। বিশেষ করে বললে, আমেরিকা ঘেঁষা সোহরাওয়ার্দীপন্থী। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ থেকে মওলানা ভাসানী বের হয়ে যান। সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে নেতৃত্ব থেকে যায় মূল আওয়ামী লীগ। এই হলো সংক্ষেপে আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রের ঐতিহাসিক দিক।
ওবায়দুল কাদের যে বক্তব্য দিয়েছেন, তিনি সেই বক্তব্যে তার দলের ঐতিহাসিক যে চরিত্র সেটাই তুল ধরেছেন। এটা তার দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেটা দেখবেন। কিন্তু তিনি বর্তমান সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীও। তার বক্তব্য যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্বের প্রতিও অবমাননাকর তখন সেই বিষয়ে এই দেশের মানুষের প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। এটা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনাও। জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সাংবাদিক মহল কি এই বিষয়ে প্রশ্ন তুলে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার দায়িত্ব পালন করবেন? কিংবা সংসদের বিরোধী দল, বাংলাদেশের বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবর্গ কি এই বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে? এই পয়েন্টেই স্পষ্ট হবে আসলে কারা বাংলাদেশপন্থী আর কারা সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল।
Discussion about this post