তেলের দামের ওপর ভিত্তি করে দেশের অধিকাংশ পণ্য ও সেবার দাম নির্ধারিত হয় বা উঠানামা করে। বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি ১৯৬৮ সালে চট্রগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। এরপর গত ৫৫ বছরে এই পরিশোধনাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা দ্বিতীয় আরেকটি পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠা কোনো সরকারের কাছেই অগ্রাধিকার পায়নি।
অথচ আমাদের দেশ বর্তমান ৭৫ লাখ টন পেট্রোলিয়াম আমদানি করে, এর মধ্যে ৬০ লাখ টন পরিশোধিত বাকি ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত। অপরিশোধিত তেল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধিত হয়। এই ৬০ লাখ টন পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানি বাবদ প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত মূল্য রাষ্ট্রকে বহন করতে হয়। তাছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারির বয়স এখন ৫৫ বছর। এর ইকোনমিক লাইফ টাইম অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এবং এটি অনেক পুরনো প্রযুক্তির একটি প্লান্টও বটে।
এখন একটি ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টন সক্ষমতার তেল পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠা দেশের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে । ৭০ লাখ টন তেল পরিশোধনে সক্ষম একটি আধুনিক নতুন প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠায় যে সম্ভাব্য ব্যয় হবে তা পাঁচ বছরের মধ্যে পরিশোধিত তেল আমদানি ব্যয়ের সাশ্রয় থেকে মেটানো যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবছর রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে পরিশোধিত তেল আমদানি বাবদ এতো বিশাল অংকের ব্যয় ভার বহন করেও সরকার কেন দ্বিতীয় আরেকটি তেল পরিশোধনাগার বা ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে না? বা নিয়েও সফল হচ্ছে না?
জানা গেছে, এর পেছনে কাজ করছে বিভিন্ন লবিস্ট গ্রুপ। নানা ধরনের লবিংয়ের কারণে দ্বিতীয় রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি প্রায় এক দশক ধরে ঝুলে আছে। অভিযোগ আছে, দ্বিতীয় তেল পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি একটি বিদেশী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ আপত্তির কারণে অগ্রসর হতে পারছে না। এই ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। এদেশের দ্বিতীয় তেল পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি যদি একটি বিদেশী কোম্পানির আপত্তির কারণে, বছরের পর বছর আটকে থাকে তবে এর দায়ভার কে নেবে?
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের আমার শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলামের একাধিক লেখার মাধ্যমে বিষয়টি সবার গোচরে আসে।
এখানে দেখা যাচ্ছে, পর্দার আড়ালে দ্বিতীয় পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠার ইস্যুটি নিয়ে নানাবিধ লবিং চালু রয়েছে। এই লবিস্টরাই পুরো প্রক্রিয়াটিকে আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছে। ২০২১ সালের ১ এপ্রিল ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) গৃহীত হয়েছিল বলে জানা যায়, যেখানে তিন মিলিয়ন টন রিফাইনিং ক্যাপাসিটির ওই দ্বিতীয় ইউনিটটি ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল, ১৯ হাজার ৩৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। কিন্তু গত আড়াই বছরেও এই প্রকল্প প্রস্তাবটি গ্রহণের আর কোনো অগ্রগতির খবর মিলছে না। বর্তমানে আর কোনো বিকল্প প্রকল্প প্রস্তাবের হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না।
তাছাড়া বেশ কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের মহেশখালীতে কুয়েতের একটি কোম্পানি তেল পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠার জন্য জমি নিয়ে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, যে সাম্প্রতিক সময়ে এই কোম্পানি তাদের পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠার কাজটি আর এগিয়ে নেয়নি। শুধু সাইনবোর্ডটি আজও রয়ে গেছে। এই পরিশোধনাগার আদৌ কি প্রতিষ্ঠিত হবে? এ ছাড়া পত্রপত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে যে, সৌদি আরবের বহুজাতিক তেল কোম্পানি আরামকো বাংলাদেশে একটি বৃহদাকার তেল পরিশোধনাগার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। খবরটি যদি সত্যি হয়, তাহলে প্রস্তাবটি এত দিনে বাস্তবায়ন পর্যায়ে চলে আসার কথা। এ ক্ষেত্রেও অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
দেশে প্রতি বছর দু’বার টেন্ডারের মাধ্যমে এই পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি করা হয়, যার বেশির ভাগই আসে সিঙ্গাপুরের একটি ফার্মের মাধ্যমে।
পরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুরের অবস্থান এখন শীর্ষে। অথচ আমরা জানি, সিঙ্গাপুর এক ফোঁটা জ্বালানি তেলও উৎপাদন করে না।
সিঙ্গাপুর যেখানে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল এনে তা পরিশোধন করে বিদেশে রফতানি করে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করছে, সেখানে বাংলাদেশ কেন শুধু তার নিজস্ব চাহিদার অংশটুকুও নিজেরা পরিশোধন করতে পারছে না।
সিঙ্গাপুর যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানির ক্ষেত্রে এতটা এগিয়ে থাকতে পারল, সেটি বহুলাংশে তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও কৌশলের কারণে সম্ভব হয়েছে। তবে এর পেছনে তাদের নিজস্ব গভীর সমুদ্রবন্দর থাকাটাও একটি বড় কারণ। এ নাব্য-গভীরতার কারণেই বিপুল পরিমাণ তেল ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বিশালাকৃতির মাদার ভেসেলগুলো সেখানে খুব সহজেই ভিড়ে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এ ধরনের গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকলেও চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের বর্তমান অবস্থানকে ব্যবহার করেও দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রবন্দরবিহীন দেশগুলোকে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য ও চীনের ইউনান প্রদেশকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশও একটি পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ছোটখাটো রফতানিকারক দেশ হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এক্ষেত্রে রফতানিকারক হওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের আভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় তেল পরিশোধনাগারও গত অর্ধশতকের ব্যবধানে এ দেশে গড়ে উঠল না। এ অবস্থায় দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা কারা কাদের স্বার্থে করেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলাটা শুধু ন্যায্যই নয়, জরুরিও বটে।
বাংলাদেশের অবস্থান ভারত মহাসাগরের মোহনায় ও প্রশান্ত মহাসাগরের অতি সন্নিকটে হওয়ায় জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার সমুদ্রবন্দরভিত্তিক সম্প্রসারণ কৌশলকে কাজে লাগাতে পরতো।
কিন্তু তা কাজে না লাগিয়ে সম্প্রতি ভারতীয় ঋণে ভারত থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা চলতি বছরের ১৮ মার্চ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন।এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের ওপর বাংলাদেশের অপ্রয়োজনীয় জ্বালানি নির্ভরতাই শুধু বাড়েনি, অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও এ প্রকল্প গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় নিয়মিত তেল সরবরাহ না পাওয়ার আশঙ্কা যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে তা কিনতে না পারা ও একতরফা মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকিও, এক্ষেত্রে চরম হতাশা ও দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে এতসব ঝুঁকি নিয়েও ভারত থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির চুক্তি করা হলো, কিন্তু এর বিপরীতে দেশে এক-দুটি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার স্থাপনের উদ্যোগকে গলাটিপে মেরে ফেলা হলো।
একটি আধুনিক তেল পরিশোধনাগারের প্রয়োজনীয়তা কতখানি, সেটা বোঝানোর জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধির হিড়িক পড়েছিল, তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সেটাকে অকেজো করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া আন্তর্জাতিক দাম থেকে অনেক কম দামে তেল বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।
বাংলাদেশকেও রাশিয়া ওই সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু রাশিয়ার ‘হেভি ক্রুড অয়েল’ পরিশোধনের সক্ষমতা আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারির না থাকায় বাংলাদেশ সে সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি।
অথচ ভারত গত দেড় বছরে রাশিয়ার এ সুবিধা নিয়ে কয়েক বিলিয়ন ডলার মুনাফা কামিয়ে নিয়েছে। তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার ক্রুড অয়েল রিফাইন করে বিক্রির মাধ্যমে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কোনো তোয়াক্কাই করেনি।
বর্তমান সরকার আসন্ন নির্বাচনের আগে শত চেষ্টায়ও এই প্রকল্প সচল করতে পারবে না, তাই ভবিষ্যতে যদি এদেশে কোনো দেশপ্রেমিক ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সিঙ্গাপুরের মতো এই প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে পারে। এবং সিঙ্গাপুর যদি তাদের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে জিডিপিতে পাঁচ শতাংশের বেশি অবদান রাখতে পারে, তাহলে অনুরূপ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের পক্ষে স্থাপন করাও সম্ভব। এবং সেক্ষেত্রে সেই সরকার ও নীতি নির্ধারকরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে কাজ করবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা ও বিশ্বাস।
মো. সহিদুল ইসলাম সুমন : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক ও গবেষক
[email protected]
Discussion about this post