মালদ্বীপে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি দল ও প্রতীকের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে জায়গা করে নিয়েছিল দেশটির ওপর ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তারের লড়াই হিসেবে। নির্বাচনের তিনদিন আগে বিবিসি ওয়ার্ল্ডের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল- ‘মালদ্বীপ : প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যালটে ভারত ও চীন’। নির্বাচনটির তাৎপর্য বোঝাতে এর চেয়ে অর্থপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম বোধহয় আর হয় না। কারণ ব্যালটে প্রার্থীদের নাম আর ছবি- যাই থাকুক, সেসব ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গ।
প্রথম দফায় ফলাফল নির্ধারিত না হওয়ায় শীর্ষ অবস্থানে থাকা দুই প্রার্থীকে নিয়ে নির্বাচন গড়ায় দ্বিতীয় দফায়। ৩০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে পরিচিত বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন বিরোধী জোটের নেতা ও রাজধানী মালে শহরের মেয়র মোহাম্মাদ মুইজ্জু। ফলাফল প্রকাশের পরই সেটিকে ভারত মহাসাগরের অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটির রাজনীতিতে চীনের জয় ও ভারতের পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ বনাম ‘ইন্ডিয়া আউট’
এমন এক নির্বাচন হয়ে গেল মালদ্বীপে, যেখানে নিজ দেশের নামের চেয়ে সম্ভবত বেশি উচ্চারিত হলো ভারত ও চীনের নাম। অন্তত আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে চোখ রাখলে সেটাই মনে হবে। রান অফ বা দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের আগে দুই প্রার্থীর পররাষ্ট্রনীতি উঠে আসে আলোচনায়। শেষ পর্যন্ত ৩০ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ভারতকে হারিয়ে ‘জয় হয়েছে’ চীনের।
ভারত মহাসাগরের বুকে এক হাজারের বেশি কোরাল দ্বীপ ও অটল নিয়ে গঠিত মালদ্বীপের জনসংখ্যা ৩ লাখেরও কম। দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য এক দশক ধরে লড়াই চলছে এশিয়ার দুই বড় শক্তির। মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব বহু বছরের পুরনো। এর মধ্যেমে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান জোরালো করেছে নয়া দিল্লি। বিশ্ব বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট মালদ্বীপের চারপাশের সমুদ্রসীমা। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে অনেক বছর ধরেই চীন প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।
এবারের নির্বাচনে বিজয়ী মোহাম্মাদ মুইজ্জু জোরালো কণ্ঠে ভারত বিরোধিতা এবং চীনের সাথে সখ্যতা নিয়ে বলেছেন। ‘ভারত হটাও’ ক্যাম্পেইন করেছেন তিনি। নির্বাচিত হলে মালদ্বীপের ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের তাড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন। অন্য দিকে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সলিহ ছিলেন ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত।
মুইজ্জুর ইন্ডিয়া হটাও ক্যম্পেইন সম্পর্কে বুঝতে হলে একটু পেছনে তাকাতে হবে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মালদ্বীপকে ২টি সামরিক হেলিকপ্টার দেয় নয়া দিল্লি, ২০২০ সালে দেয় একটি ছোট বিমান। ভারত বলছে, সার্চ এন্ড রেসকিউ অপারেশন এবং এমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিসের জন্য এগুলো ব্যবহৃত হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন ২০২১ সালে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায় যে, এই আকাশযানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৭৫ সদস্যের একটি ভারতীয় সেনাদল মালদ্বীপে অবস্থান করছে।
বিরোধীরা দ্রুততার সাথে ‘ভারত হটাও’ আন্দোলন শুরু করে। তারা বলতে থাকে, বিদেশী সেনাদের উপস্থিতি মালদ্বীপের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আর এই ইস্যুটিই এবারের নির্বচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জনগণের একটি বিরাট অংশ- বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ভারতীয় সেনা উপস্থিতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা বিরোধী নেতা মুইজ্জুর আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়।
যদিও প্রেসিডেন্ট সলিহ বলেছেন, বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। তার মতে, ভারতীয় সেনারা মালদ্বীপের ডিফেন্স ফোর্সের কমান্ডেই মালদ্বীপে কাজ করছে। তাদের আলাদা কোনো সামরিক সত্ত্বা নেই; কিন্তু তার সেই যুক্তি যে ধোপে টেকেনি সেটা তো ভোটের ফলাফলেই প্রমাণিত হয়েছে।
সলিহ ও মুইজ্জুর ভোটযুদ্ধ
প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপের প্রার্থী মুইজ্জু রাজধানী শহরের মেয়র ছিলেন। ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষা নেয়া ৪৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিক এর আগের মেয়াদে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের প্রশাসনে অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বেই চীনা বিনিয়োগে দেশটিতে প্রচুর অবকাঠামো নির্মিত হয়। গত বছর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সাথে এক ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেছেন, তার দল ক্ষমতায় এলে দুই দেশের মধ্যে আবার শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে উঠবে। দুর্নীতির দায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের জেল হওয়ার ফলে তার জায়গায় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান মুইজ্জু।
এরপর তিনি ইয়ামিনের রাজনৈতিক নীতির উত্তরাধিকারী হিসেবেই ভোটের মাঠে নামেন। মুইজ্জু ভোটে জেতায় দেশটিতে ইয়মিনের শাসনের মতো ধরপাকড় শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট সলিহ দ্বিতীয় দফা ভোটের আগে বলেছেন, তারা শঙ্কায় আছেন।
২০১৩ থেকে ২০১৮ সালে ইয়ামিনের শাসনে বিরোধী জোটের ওপর ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ ওঠে। সেই প্রশাসনে মন্ত্রী ছিলেন মুইজ্জু। তাই আবারো দেশটিতে তেমন কিছু হবে কি না সেই শঙ্কাই এখন অনেকের মনে। যদিও মুইজ্জু বলেছেন, তিনি ধরপাকড়ের রাজনীতি করেন না। ভিন্নমত পোষণকারীদের ওপর দমন নীতিতে বিশ্বাস করেন না।
২০১৮ সালে নির্বাচনে সলিহ জিতেছিলেন ইয়ামিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের কারণেই। তারা ইয়ামিন প্রশাসনকে প্রত্যাখান করে সেই নির্বাচনে; কিন্তু ৫ বছর পরে মুইজ্জু ইয়ামিনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ঠিকই আবার মালদ্বীপবাসীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলেন। তার পূর্বসূরীর প্রতি জনগণের ক্ষোভ থাকলেও মালদ্বীপের ভোটাররা মুইজ্জুকে কেন বেছে নিলেন- তার উত্তর দেয়া সহজ নয়। তবে এক্ষেত্রে মুইজ্জোর ভারত হটাও ক্যাম্পেইনের জোর ভূমিকা আছে অবশ্যই। যেটি তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাপক ভারত বিরোধী পোস্ট দেখা গেছে।
ভারত-চীন লড়াই
সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের সাথে মালদ্বীপের যোগাযোগ কয়েক শতাব্দীর। দেশটির সাথে নয়া দিল্লির সম্পর্ক অনেক বছর পুরনো; কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে ঢুকে পড়ছে বেইজিং। ২০১০ সালের পর মালদ্বীপের অবকাঠামোখাতে প্রচুর ঋণ সহায়তা দিয়েছে মালদ্বীপ।
২০১৩ থেকে ২০১৮ মেয়াদে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সময়েই মূলত চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে মালদ্বীপ। শি চিন পিংয়ের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পে যোগ দেয় দেশটি। বিবিসি বলছে, ওই সময়টাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিরোধী মতের ওপর ধরপাকড়ের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারত ঋণ সহায়তা দেয়নি দেশটিকে। যে কারণে কোনো শর্ত ছাড়াই চীনমুখী হয়ে পড়েন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। ক্ষমতা ছাড়ার পর দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হতে হয় ইয়ামিনকে। এই অভিযোগে বর্তমানে ১১ বছরে কারাবাস চলছে তার। ইয়মিনের প্রক্সি হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে মুইজ্জুকে। যে কারণে ইয়ামিনের সাথে নয়া দিল্লির যে দূরত্বের সম্পর্ক ছিলো সেটাই হয়তো বজায় রাখবেন মুইজ্জু।
ইয়ামিন প্রশাসনের সময় মালদ্বীপে চীনের সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর একটি ছিলো ২ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু। যে সেতুটি রাজধানী মালের সাথে পার্শ্ববর্তী একটি দ্বীপকে যুক্ত করেছে। ওই দ্বীপটিতেই মালদ্বীপের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমাবন্দর। ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই সেতুটি ইয়ামিন প্রশাসনের শেষ দিকে উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে চীন প্রচুর ঋণ দিয়েছে দেশটিকে।
প্রেসিডেন্ট সলিহ’র সময়ে ভারতও এর সাথে পাল্লা দিয়ে মালদ্বীপকে ঋণ দিতে শুরু করে। গত কয়েক বছরে তারা ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে দেশটির বিভিন্ন প্রকল্পে। যদিও মালদ্বীপবাসী ভারতের এই বিনিয়োগকে সন্দেহের চোখে দেখছে। সমালোচকরা বলছেন, এর মাধ্যমে ভারত প্রত্যক্ষভাবে দেশটিতে প্রভাব বিস্তার করছে।
মুইজ্জুর সামনে চ্যালেঞ্জ
আলজাজিরার প্রতিনিধি টনি চেং মালে থেকে লিখেছেন, মুইজ্জুকে তার নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো পূরণ করতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে হয়তো। কারণ দেশটির অর্থায়ন, বাণিজ্য, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে ভারত ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি যদি সেসব থেকে ভারতকে সরাতে চান, সেটি সহজ হবে না। যদিও তিনি প্রকাশ্যেই চীনপন্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছেন।
সেই সাথে মুইজ্জু তার চীনপন্থী নীতি নিয়ে যে পশ্চিমাদের বিরোধিতার মুখে পড়বেন সেটিও অজানা কিছু নয়। কারণ ভারত মহাসাগরসহ সমগ্র অঞ্চলে চীনা আধিপত্য ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রও অনেক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যাবে ভারতের সাথে ওয়াশিংটনের সমীকরণ। যে কারণে মালদ্বীপ ইস্যুতে এখন ওয়াশিংটন ও নয়া দিল্লি এক বিন্দুতে এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মালদ্বীপে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ভারতকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চীন এই সুযোগ অঞ্চলটিতে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে নিতে চাইবে। যা নিয়ে নয়া দিল্লি বহুদিন ধরেই উদ্বিগ্ন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, চীন হয়তো আরো বেশি ঋণের ফাঁদে ফেলবে মালদ্বীপকে। যেভাবে তারা মালদ্বীপের কাছের শ্রীলঙ্কাকে ফাঁদে ফেলেছে। তাদের ভাষ্য, অতিরিক্ত ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বেইজিং বিভিন্ন দেশে নিজের কৌশলগত সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। মালদ্বীপও হয়তো একই পরিণতির দিকে যাবে। সেইসাথে ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে মাত্র ৩০০ নটিক্যাল মাইল দূরের একটি দেশে প্রভাব হারানোয় নয়া দিল্লির শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে বলেও মনে করছে তারা।
এছাড়া চীন-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা আবার জেগে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট সলিহ’র সময় এই চুক্তিটির আলোচনা থামিয়ে রাখা হয়েছিল; কিন্তু মুইজ্জুর প্রশাসন সেটি আবার শুরু করতে পারে। যেটি ঘটলে চীনই বেশি লাভবান হবে, কারণ মালদ্বীপে তারা যে পরিমাণ রফতানি করে, আমদানি তার সামান্য অংশ। অর্থাৎ বেইজিং ও মুইজ্জু উভয়ের জন্যই এটা উইন উইন সিচুয়েশন।
Discussion about this post