উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত উক্তি, ‘একটি ভাল সংকটকে কখনই নষ্ট হতে দিও না।’
এই উক্তিটি এক বছর আগের শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। দেশটি স্বাধীনতার পর সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের পড়েছিল এ সময়। কিন্তু এই সংকট তাদের সামনে কিছু সুযোগ এনে দেয়। প্রয়োজনীয় অনেক সংস্কারের সুযোগ তৈরি হয়। সংকটে এমন উদাহরণ আমরা আরও দেখতে পাই। ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো অনেক দেশ গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের পর ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে এবং পরে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কা সরকারও বিরাজমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে এমন কিছু করার সুযোগ পেয়েছে, যা তারা আগে কখনোই করেনি এমনকি চেষ্টাও করেনি।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটের তীব্রতার সময় চরম জ্বালানি ও গ্যাসের ঘাটতি দেখা গেছে, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটেছে, হাইপার ইনফ্লেশন ঘটেছে, ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে বিদ্যুতের চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে শ্রীলঙ্কাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এবং এখনও দেশটিকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কয়েক দশকের রাজস্ব ঘাটতি, চলতি হিসাবের ঘাটতি, স্ফীত সরকারী খাত, কর রাজস্ব হ্রাস ও ভর্তুকি মূল্য দেশটিকে এই অবস্থার দিকে নিয়ে গেছে।
এক বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানি সংকট চরমে পৌঁছায়, আর পেট্রল পাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। জন-অসন্তোষ চরমে ওঠে। গণরোষের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। দায়িত্ব নেন রানিল বিক্রমাসিংহে।
রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়া শ্রীলংকার জন্য গত বছর আরো বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল মূল্যস্ফীতি। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। বিপাকে পড়ে গৃহস্থালি থেকে শুরু করে শিল্পোৎপাদন পর্যন্ত অর্থনীতির সব খাত-উপখাত। বছর শেষে অর্থনীতিতে সংকোচনের হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো জাদুবলে নয় বরং নীতিগত কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ধ্বংসের কাছে যাওয়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। এখন দেশটির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন পর্যটন খাতে সুদিন ফিরছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, শিল্প উৎপাদন বাড়ছে এবং কৃষি উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর পেছনে মূল কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে দ্বীপদেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিংহেকে। তার নেতৃত্বে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার (সিবিএসএল) নেয়া পদক্ষেপগুলোই দেশটিকে কার্যকরভাবে সমৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে এনেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় গত জুলাইয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও অর্থমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই দেউলিয়াত্ব থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্য পূরণে তার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গাও এখন নন্দলাল বীরাসিংহে।
২০২২ এর সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে এ বছরের জুলাইয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশে এসে দাঁড়ায় মূল্যস্ফীতির হার। আগস্টে তা কমে ৪ শতাংশ হয়। অর্থাৎ প্রায় এক বছরের মাথায় দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬৯.৮ শতাংশ থেকে ৬.৩ শতাংশে নেমে এলো। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদ প্রকাশ করেছে, আরও বেশ কয়েক মাস মূল্যস্ফীতির এই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে।
সাধারণত অর্থনীতিবিদরা আগের বছর বা মাস অথবা কোনো নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, আবাসন, সেবা প্রভৃতি উপাদানগুলোর দাম বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন, সেটাই মূল্যস্ফীতি।
শ্রীলঙ্কার ব্রোকারেজ হাউস অ্যাকুইটি স্টক ব্রোকারের গবেষণা প্রধান শিহান কুরে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুতগতিতে কমছে। অংশত এর কারণ হচ্ছে শ্রীলঙ্কার রুপির দরবৃদ্ধি, যে কারণে আমদানি ব্যয় কমেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আশা করছি মূল্যস্ফীতির হার এভাবে কমতে থাকবে এবং বছরের শেষ নাগাদ তা ৫ শতাংশের ঘরে নেমে আসবে।’
একটি বিবৃতিতে, সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ শ্রীলঙ্কা (সিবিএসএল) উল্লেখ করেছে যে ‘এই নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়াটি কঠোর আর্থিক এবং রাজস্ব নীতির পিছিয়ে যাওয়া প্রভাব, সরবরাহের দিকের উন্নতি, শক্তি এবং খাদ্যের মূল্যস্ফীতি এবং অনুকূল মৌলিক বিষয়গুলির দ্বারা সমর্থিত।’
১ জুন,২০২৩ শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার ২৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছে, যা ২০২২ সালে দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতির ‘ঐতিহাসিক সংকোচনের’ পর প্রথম পদক্ষেপ, এটি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করবে এবং প্রবৃদ্ধির জন্য প্রেরণা দেবে। (যে সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকসমূহকে ঋণ দেয়, সেটিই রেপো রেট বা নীতি সুদহার। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতেই মুদ্রানীতির এ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারটি ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।)
শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের মনিটারি বোর্ড নীতি সুদের হার ২৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই বলে যে, মুদ্রাস্ফীতি প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত কমছে।
ব্যাংকের পর্ষদ ৩১ মে একটি সভা করেছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থায়ী আমানত সুবিধা হার (SDFR)এবং স্থায়ী ঋণ সুবিধার হার (SLFR) ২৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে যথাক্রমে ১৩.০০% এবং ১৪.০০% করেছে।
সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক বলেছে, ‘মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশিত গতির চেয়ে দ্রুত ধীরগতি, মুদ্রাস্ফীতির চাপের ক্রমান্বয়ে বিলীন হওয়া এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশাকে আরও নোঙর করার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আর্থিক অবস্থা সহজ করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে’, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ।
‘এই ধরনের আর্থিক সহজীকরণের সূচনা আর্থিক বাজারে চাপ কমানোর সময় ২০২২ সালে প্রত্যক্ষ করা কার্যকলাপের ঐতিহাসিক সংকোচন থেকে অর্থনীতির জন্য একটি অনুপ্রেরণা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
‘আগামী সময়ের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, প্রত্যাশিত সময়ের আগে একক-অঙ্কের স্তরে পৌঁছাবে’ বলে বিবৃতিতে আশা করা হয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অফিস ঘোষণা করেছে যে, মে মাসে মূল্যস্ফীতি ২৫.২% রেকর্ড করা হয়েছে, যা এপ্রিলের ৩৫.৩% থেকে কমেছে।
জানুয়ারিতে রেকর্ড ৩৬০ রুপি থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপির দাম ২৯৫-এ নেমে এসেছে।
মে মাসের শেষের দিকে অফিসিয়াল রিজার্ভ ৩ বিলিয়নের ওপরে উন্নীত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, মার্চে আইএমএফ ২.৯০ বিলিয়ন ডলার বেলআউটের পর থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখেছে। অধিকন্তু, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) ও বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদাররা আর্থিক সহায়তা এবং ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যাইহোক, দেশটি সম্প্রতি তার ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার এই বছরের জুনে ১২% থেকে জুলাই মাসে ৬.৩%-এ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে – যা সত্যিই একটি প্রশংসনীয় অর্জন। মনে হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা তার আর্থিক সঙ্কট থেকে ফিরে আসার পথে খুব ভালভাবে এগিয়ে চলেছে, যা একসময় প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল।
১৭ আগস্ট, শ্রীলঙ্কা ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশের ঋণের ৭৫ শতাংশ ফেরত দিয়েছে দেশটি। এমনকি অন্যান্য দেশ ও সংস্থার ঋণও এখন একটু একটু করে পরিশোধ করে দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে আইএমএফ-এর প্রায় ৩ বিলিয়ন বেলআউট (যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করেছিল), আমদানি বিধিনিষেধ এবং বিদ্যুতের ঘাটতি উন্নত করতে গৃহীত পদক্ষেপগুলি মূল্যস্ফীতিকে অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করেছে।
সিবিএসএলে নন্দলাল বীরাসিংহে ও তার সহকর্মীরা এতদিন শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার ওপর জোর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। সেটি নিয়ন্ত্রণে আসায় তারা এখন মনোযোগ দিচ্ছেন অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনার ওপর। গত বছর দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশে। চলতি বছর তা ২ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে শিগগিরই সুদহার ২০০ বেসিস পয়েন্ট (২ শতাংশ) কমিয়ে আনার কথা ভাবছে সিবিএসএল। এর আগে জুন ও জুলাইয়ে সুদহার ৪৫০ বেসিস পয়েন্ট (সাড়ে ৪ শতাংশ) কমিয়েছিল দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এর কিছুদিন আগেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রাসীভাবে বাড়ানো হয়েছে সুদহার। চলতি বছরের এপ্রিল ও মার্চে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছিল রেকর্ড ১ হাজার ৫০ বেসিস পয়েন্ট (সাড়ে ১০ শতাংশ)।
মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার বিশেষজ্ঞ নন্দলাল বীরাসিংহে দায়িত্ব নিলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেশ কিছুদিন নিজের ক্যারিশমা দেখানোর সুযোগ পাননি। কেননা আর্থিক দেউলিয়াত্ব, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের সংকট ক্ষুব্ধ লঙ্কাবাসীকে রাস্তায় নামিয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল রাষ্ট্র ও প্রশাসন। রাষ্ট্র ও সরকারের নির্বাহী প্রধানরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের মে মাসের মাঝামাঝি এক বক্তব্যে নন্দলাল বীরাসিংহে বলেন, ‘অনতিবিলম্বে সরকার গঠন না হলে শ্রীলংকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আর কোনো আশাই থাকবে না।’ তার সে হুঁশিয়ারির মধ্যেই নতুন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। এরপরও দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফেরায় পদত্যাগের হুমকি দেন ড. নন্দলাল বীরাসিংহে।
গোতাবায়া রাজাপক্ষে ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরতে থাকে। পরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন রনিল বিক্রমাসিংহে। নন্দলাল বীরাসিংহে শ্রীলঙ্কার আর্থিক ও মুদ্রাবাজার খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হওয়ার সুযোগ পান। যদিও মূল্যস্ফীতি ততদিনে নিয়ন্ত্রণের প্রায় ঊর্ধ্বে, যা সেপ্টেম্বরে গিয়ে দাঁড়ায় রেকর্ড সর্বোচ্চে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আগ্রাসীভাবেই সুদহার বাড়াতে থাকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগ্রাসী সুদহার নীতির সুফলও মিলতে থাকে। নিয়ন্ত্রণে আসে ঋণের প্রবাহ। আবার এ বর্ধিত সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় বাজারভিত্তিক পদ্ধতিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা (বিশেষ করে ডলার) ক্রয়-বিক্রয়ের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঠেকানো হয় রুপির বিনিময় হারে পতনকে। এক পর্যায়ে ডলারসহ অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে লঙ্কান রুপির বিনিময় হার বাড়তে থাকে।
এখন অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কা একটু একটু করে কাটিয়ে উঠছে দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা। আর তার সুফল পেতে শুরু করেছে দেশটির জনগণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো জাদুবলে নয় বরং নীতিগত কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ধ্বংসের কাছে যাওয়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশটির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন পর্যটন খাতে সুদিন ফিরছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, শিল্প উৎপাদন বাড়ছে এবং কৃষি উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার উন্নতি দেখে আমরা খুশি হলেও আমাদের নিজস্ব মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ক্রমবর্ধমান খাবারের দাম উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডিমের মতো খাবার কিনতেও সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অনুসারে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ১২.৫৪% যেখানে ২০২২ সালের জুলাই মাসে তা ছিল ৮.১৯%।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বিশেষজ্ঞদের কাছে পৌঁছেছে একটি অন্তর্দৃষ্টি পেতে, কেন আমরা এখনও মূল্যস্ফীতি কমাতে লড়াই করছি যখন আমাদের সংকট শ্রীলঙ্কার মতো গভীর নয়?
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শ্রীলঙ্কা তাদের নীতিগত হার (স্বল্পমেয়াদী সুদের হার) উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে, যা তাদের বাজারে প্রভাব ফেলেছে।‘তাদের আমাদের মতো সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। আমাদের ঋণের হারের ওপর একটি ক্যাপ আছে, যে কারণে সুদের হার বা নীতির হার বাড়ানোর ফলে বাজারে প্রভাব তৈরির কোনো সুযোগ নেই।’
অন্যান্য প্রচলিত নীতি পদক্ষেপের মধ্যে, শ্রীলঙ্কা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্ব কৃচ্ছ্রতা নীতি গ্রহণ করেছে (সরকারি ব্যয় কমিয়ে এবং/অথবা কর বৃদ্ধি করে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে)। এইভাবে তারা কর বাড়িয়েছে বা ব্যয় কমিয়েছে বা রাজস্ব ঘাটতি কমাতে উভয়ের সংমিশ্রণ ব্যবহার করতে পারে।
‘কোভিড -১৯ মহামারীর কারণে, যখন পর্যটন কমে গিয়েছিল, তখন শ্রীলঙ্কা একটি কঠিন আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল এবং এর বৈদেশিক মুদ্রার হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য দেশটির পর্যটনের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল খুব বেশি। একসময় পর্যটন শূন্য হয়ে গিয়েছিল, এটি ইতিমধ্যে দুর্বল অর্থনীতির কফিনে চূড়ান্ত পেরেক ঠুকেছিল।”
‘আমরা শ্রীলঙ্কার মতো পদক্ষেপ নিতে পারতাম কিন্তু আমরা তা করিনি। আমাদের সম্ভবত এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজন হতো না কারণ আমাদের অর্থনীতি এতোটা ভঙ্গুর নয়। আমাদের এখনও এমন কোনো সংকট নেই যেখানে তাদের একটি সংকট-পরবর্তী পরিস্থিতি, দুটি ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড আছে।’
‘আমাদের অর্থনৈতিক বিবরণ ছিল যে, যা কিছু ঘটছে তা সরবরাহের কারণে ঘটছে, এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঘটেছে এবং সরবরাহের দিকটি উন্নত হলে এটি চলে যাবে এবং এটি পরিবর্তন করার জন্য আমাদের কিছুই করার নেই।’
সেই বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়। এখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার দিকটি বিবেচনা করা উচিত ছিল।
‘বিশাল মহামারী-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের অংশ হিসাবে যখন আমদানি বেড়েছে, তখন আমাদের বোঝা উচিত ছিল যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা এতে একটি ভূমিকা পালন করেছে এবং এটি সরবরাহের বিষয় নয়। আমরা তখন এটিতে কোনও মনোযোগ দেইনি, যদিও এখন আমরা চাহিদা কমিয়েছি। যেমন আমরা আমদানি কমিয়েছি, কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমাইনি।’
গত বছরের মতো যদি অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ নতুন টাকা ছাপানো ও বাজারে ছাড়া হয়, তবে ‘এখান থেকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে, আমাদের খুব বেশি কিছু করতে হবে না।’ যখন মূল অর্থ বৃদ্ধি পাবে, এটি একটি গুণক প্রভাব তৈরি করবে এবং পরিস্থিতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ করবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, বাংলাদেশ কেন মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না তার খুব সহজ উত্তর আছে। সেটি হলো, ‘বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা কিছু না করেই মুদ্রাস্ফীতি কমানোর অনেক কথা বলেছেন। বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে ‘ঋণের হারের ওপর ক্যাপ, সরকারি বাজেটের অর্থায়ন (যা টাকা ছাপানোর সমতুল্য) এবং বর্ধিত পুনঃঅর্থায়ন সুবিধাকে দায়ী করা যায়।
আইএমএফ সম্প্রতি জানিয়েছে, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখালেও দেশটিকে আরও কিছু কষ্টদায়ক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। বাংলাদেশে অবশ্য সংস্কার কর্মসূচির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না, যদিও সংকট এরই মধ্যে বেশ ঘণীভূত হয়েছে।
Discussion about this post