ব্রিকস সম্মেলন থেকে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলনটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার ছিল এই সংবাদ সম্মেলন থেকে। যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে ২৯ আগস্ট বিকেল চারটায় বসেছিলাম টেলিভিশনের সামনে। প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষ হওয়ার পর শুরু প্রশ্নোত্তর পর্ব।
ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ না পাওয়া এবং জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোচনার মধ্যেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিসেবে আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যু। ওইদিন সকালেই গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন আরও ১৮ শ্রমিক। ঠিক এর আগের দিনই ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত এবং সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নে আসে ড. ইউনূসের বিষয়টি। এ সংক্রান্ত প্রশ্নে কিছুটা ঊষ্মা প্রকাশ করলেও বেশ সাবলীলভাবে উত্তর দিতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী আইন ও শ্রমিকের অধিকারের কথা টানা বলে গেলেন।
ড. ইউনূসের মামলার প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শ্রমিক অধিকার নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়। আমাদের বিরুদ্ধে আইএলওতে নালিশ আর নালিশ। কিন্তু দেশে কোম্পানি আইনে আছে, প্রফিটের ৫ শতাংশ লেবার ওয়েলফেয়ারে দিতে হবে। সেটা না দেওয়ায় লেবাররা মামলা করায় তাদের স্যাক (চাকরিচ্যুত) করা হয়। স্যাক করায় আবার তারা মামলা করে। সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের না। মামলা তো আমরা করিনি।’ আওয়ামী লীগ সব সময় শ্রমিকদের স্বার্থ দেখেছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বড় বড় কথা বলবে আর মাঝখান থেকে শ্রমিকের টাকা আত্মসাৎ করবে। চমৎকার বাংলাদেশের লোক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একেবারে লাফ দিয়ে পড়ল। প্রতিদিন আমাদের লেবার নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করে দেয়। শ্রমিকদের যেটা পাওনা, সেটা দিতে হবে। অল্প কিছু দিয়ে বাকিটা ঘুষ দিয়ে বন্ধ করা, এটা কি ন্যায়বিচারের কথা? এটা সততার কাজ?’
খুবই ভাল কথা। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যেদেশে শ্রমিকের জন্য এত সুন্দর সুন্দর আইন আছে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকের অধিকার আদায়ে কঠোর অবস্থানে; সেই দেশের শ্রমিকরা কেন বঞ্চিত হয় কোম্পানির মুনাফা থেকে? সেই দেশের শ্রমিকদের চাকরি কেন স্থায়ী করা হয় না বছরের পর বছর? সেই দেশের শ্রমিককে কিভাবে বিনানোটিশে চাকরিচ্যুত করা যায়? এসব প্রতিনিয়ত ঘটে এই দেশে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ভাগ্যে। এই যে লাখ লাখ পোশাকশ্রমিক দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তারা কি কেউ কখনো শ্রম আইনের সুবিধা ভোগ করেছেন? তারা কি কখনো কোম্পানির মুনাফা পেয়েছেন? আমার তো মনে হয়, এমন দাবি কোনো কারখানা মালিকও করবেন না। কিন্তু ঠিকই এই আইনের জালে ফেঁসে যাচ্ছেন ড. ইউনূস। তাহলে কি এই আইন শুধু ড. ইউনূসদের মতো কিছু মানুষের জন্য বানানো?
২২ আগস্ট শ্রম আইন লঙ্ঘনের আরেক মামলায় ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মামলাটি করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান মামলাটি করেন। অভিযোগ থেকে জানা যায়, অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যান। সেখানে তারা শ্রম আইনের লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে পারেন। এর মধ্যে ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি। শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।
এখানে উল্লেখ্য হলো—একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে প্রায় একযুগ কর্মরত থাকার পরও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কার্যক্রম বিষয়ে আমার খুব একটা জানা ছিল না। এটা হতে পারে আমার অজ্ঞতাও। তাই এই প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে সার্চ দিলাম গুগলে। গুগল সার্চে তাদের কার্যকলাপ বলতে শুধুই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার খবর। এবার শুধু ইমেজ অপশনে ক্লিক করলে আসে সংস্থাটির হাতেগোনা কয়েকটি লোগো ও একজন কর্মকর্তার ঘুষ গ্রহণের পর গ্রেপ্তার হওয়ার ছবি। এবার প্রশ্নটা আরও তীব্র হয়, তাহলে কি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কার্যক্রমও শুধুমাত্র ড. ইউনূসের মতো মানুষদের কারখানা পরিদর্শনে সীমাবদ্ধ? একযুগের বেশি সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ীভাবে চাকরি করলাম, কই কোনোদিন তো এই সংস্থার লোকজনকে তো দেখিনি।
এর আগে গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মী শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল থেকে মুনাফা পাওয়ার অধিকারী বলে রায় দিয়েছিল শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। এর বৈধতা নিয়ে গ্রামীণ কল্যাণের পক্ষে করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দিয়ে ওই বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেন। হাইকোর্টের দেওয়া এ–সংক্রান্ত রুল দুই মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে গত ১০ জুলাই নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। আইনজীবীদের তথ্যমতে, গ্রামীণ কল্যাণের সাবেক ১০৬ কর্মী শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল থেকে মুনাফা (২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত) পেতে শ্রম আইনের ২৩১ ধারায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা (ব্যাখ্যামূলক) করেন।
এ বিষয়ে গুগলে সার্চ করেছিলাম, ‘শ্রমিকের মুনাফা দিতে রুল’ লিখে। দেখতে চেয়েছিলাম, আরও কোনো প্রতিষ্ঠানকে এভাবে শ্রমিকের মুনাফা দিতে রুল দিয়েছে কি না আদালত। সে বিষয়েও ড. ইউনূস ও তার গ্রামীণ কল্যাণ ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের নাম দেখা যায়নি সার্চবারে। তখন আবারও প্রশ্ন জাগে, তাহলে এই আইন কি শুধুই ড. ইউনূসের জন্য! যদি শ্রমিকের জন্যই হয়, তাহলে দুই দফায় সরকারের দুইজন মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানে ১০ বছরেরও বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও তো আমি কোনো মুনাফা পাইনি। এমনকি জানিও না, আমার প্রতিষ্ঠান কত টাকা মুনাফা করে?
তবে সবকিছু তো আর গুগল সার্চ দিয়ে বিচার করা যায় না। হয়তবা আমাদের দেশে শ্রম আইনের ব্যবহার যথেষ্ঠই হয়। শ্রমিকরাও তাদের অধিকার বুঝে পায়। এই আইন আরও সমৃদ্ধ হোক। এই আইনের সুফল মিলুক প্রত্যেকটি শ্রমিকের। ড. ইউনূস যদি অপরাধী হোন, তাহলে তার বিচার হোক। তবে সেই সঙ্গে যেন বিচার হয় দেশের সব শিল্প মালিকদের, যারা তাদের শ্রমিককে মুনাফার একপয়সাও দেন না। বিচার হোক, সেইসব প্রতিষ্ঠানের, যেসব প্রতিষ্ঠান তার শ্রমিককে বছরের পর বছর অস্থায়ী করে রাখে।
Discussion about this post