ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির কথা পাল্টে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। গানটিতে ‘বাঙালির পণ বাঙালির আশা’ এবং ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন’ যে লাইনগুলিতে আছে, সেখানে বাঙালির বদলে ‘বাংলার পণ বাংলার আশা’ ইত্যাদি করা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
এরপর এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে সম্পাদকীয়। তাতে মমতাকে নিয়ে কড়া সমালোচনা হয়েছে। মমতার এমন মন্তব্যে অসন্তুষ্ট কবীর সুমনও। ফেসবুকসহ অন্যত্রও সমালোচনা হচ্ছে মমতার মন্তব্য নিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জন্য পহেলা বৈশাখ দিনটিকে ‘বাংলা দিবস’ আর রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি গ্রহণ করার জন্য মঙ্গলবার এক সর্বদলীয় বৈঠকে মমতা বন্দোপাধ্যায় ওই প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেন, ‘রাখি বন্ধনের জন্য রবীন্দ্রনাথ যখন গানটি লিখেছিলেন, তখন তিনি সব সমাজকে নিয়ে কথা বলেছিলেন, যারা বাংলায় কথা বলেন। কিন্তু এখন বাংলায় বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায়, ধর্মের মানুষ বাস করেন। তিনি বেঁচে থাকলে বলতেন ‘বাংলার’। তাই বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন-এর জায়গায় বাংলার প্রাণ বাংলার মন বাংলার ঘরে যত ভাইবোন– এটা ব্যবহার করতে পারি কি না, মতামত চাইব।’
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড কার্জন যখন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ দেন, তার প্রতিবাদ হয়েছিল বিশেষত বাঙালি সম্ভ্রান্ত হিন্দু সমাজে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং রাস্তায় নেমেছিলেন সেদিন। ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’ বজায় রাখতে রাখি বন্ধন উৎসব হয়েছিল কলকাতার রাস্তায়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরোয়া’ বইতে লিখেছেন, ‘রবিকাকা একদিন বললেন, রাখিবন্ধন উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখি পরাতে হবে। ক্ষেত্রমোহন কথকঠাকুর খুব খুশি ও উৎসাহী হয়ে উঠলেন, বললেন, এ আমি পাঁজিতে তুলে দেব, এই রাখিবন্ধন উৎসব পাঁজিতে থেকে যাবে। ঠিক হলো, সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখি পরাবে। রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাত থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে… মেয়েরা খই ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম, যেন একটা শোভাযাত্রা। দিনুও (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল… ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/…পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।- এই গানটি সেই সময়েই তৈরি হয়েছিল’।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরের ঘটনা বিবৃত করেছেন। তার ওই বইয়ে আরো কিছু বিবরণ আছে। যাতে দেখা যায় মসজিদে ঢুকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৌলভীদের রাখি পরিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে এক কুলি নিজের দিনের উপার্জন চাঁদা হিসেবে দিচ্ছেন। এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে স্বদেশি আন্দোলনও জোরদার হচ্ছে। অবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ধূতি পরা শুরু করেছেন তারা। এমনকি বিলাত থেকে ফেরা লোকজন প্যান্ট বাদ দিয়ে ধূতি শুরু করেন।
এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীজেন্দ্রলাল রায় অনেক গান লিখেছিলেন। স্বদেশি আন্দোলনের ডাকে বিলাতি কাপড় পরা বাদ দেওয়া হয়।
বঙ্গভঙ্গ লর্ড কার্জন কেন করেছিলেন তা নিয়ে ইতিহাসে বিতর্ক আছে। তার পক্ষ থেকে তখন যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, এত বড় বাংলা অঞ্চল, নদী-খাল পেরিয়ে একজনের পক্ষে পূর্ব বাংলা ও আসাম শাসন করা কষ্টকর। ফলে আলাদাভাবে একটি রাজ্য থাকলে তাতে একজন প্রশাসক বসিয়ে শাসন পরিচালনায় সুবিধা পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে এ আলোচনাও আছে যে, বাংলা অঞ্চল ইংরেজদের কিছুতে মানতে চাইত না। তারা সবসময় বিদ্রোহী আচরণ করত। তাদের আলাদা করে এক ধরনের শায়েস্তা করা আবার বাদবাকি অংশকে বিপদমুক্ত রাখার কৌশল হিসেবে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব করেন লর্ড কার্জন।
তবে এ ধরনের আলোচনাও আছে যে, চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলায় পাঞ্জাবকে ঘিরে একটি মুসলিম অঞ্চল এবং পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে আরেকটি মুসলিম অঞ্চল গঠন করতে চেয়েছিলেন কার্জন।
আবার এটাও সত্য কথা যে, পূর্ববঙ্গের বিশাল অংশের মুসলমানরা ছিল অধিকার ও সুবিধাবঞ্চিত। আসাম অঞ্চলও কলকাতার চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। শুধু মুসলমানরা নয়, নিম্নবিত্ত হিন্দু পরিবারও অবহেলিত, দুর্দশাগ্রস্ত ছিল। নতুন একটি প্রদেশ হলে তাদের জন্য তা সুবিধার হতো। যদিও অনেক মুসলিমই বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেনি। তারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে ছিল। তবে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলমানদের বড় একটা অংশ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেয়। যার ফলে পরে মুসলিম লীগ গড়ে ওঠে।
যদিও ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। তবে তার আগে বঙ্গভঙ্গ বিরোধীরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের আন্দোলনের ফলে নিম্নবিত্ত হিন্দু ও মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন বিলাতি কাপড়, পণ্য, লবণ ইত্যাদি বাদ দিতে গিয়ে, দেশি কাপড় পরতে গিয়ে বা পণ্য কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাদের। বঙ্গভঙ্গ ছিল মূলত কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আন্দোলন। তাদের মনে ভয় ছিল যদি বাংলা ভাগ হয়ে যায় তাহলে মামলা-মোকদ্দমার জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে লোকেরা তাদের কাছে আসবে না। কলকাতা যে বাংলার রাজধানী ছিল সেটা আর থাকবে না। ঢাকা আলাদা রাজধানী হয়ে যাবে। পত্রিকা বের হবে আলাদাভাবে।
বাংলাপিডিয়ায় বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে বলা হয়, ‘শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুরা অনুভব করে যে, এটা ছিল বাংলা-ভাষাভাষী জনগণের জাতীয় সচেতনতা ও ক্রমবর্ধমান সংহতির ওপর কার্জনের হানা সুচিন্তিত আঘাত। বাংলার অধিকাংশ বাণিজ্য ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণকারী এবং গ্রাম্যসমাজে নেতৃত্ব দানকারী হিন্দুগণ মত প্রকাশ করে যে, বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ বিহার ও উড়িষ্যা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাপ্রদেশেও তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। তারা অভিযোগ তোলে যে, এটা ছিল বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শ্বাসরূদ্ধ করতে কার্জনের গোপন প্রচেষ্টা। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে, শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের অতি দ্রুত বর্ধনশীল শক্তিমত্তাকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ব বাংলার মুসলিম প্রভাব বাড়ানোকে উৎসাহিত করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল। তাই বিভক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে তীব্রতর করতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থসমূহ একত্রে জোট বেঁধেছিল।’
এই শ্রেণী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই আন্দোলন পরিচালনা করে। তারা ব্রিটিশদের দায়ী করে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের জন্য। তারা মনে করে, দেশপ্রেমই আসল। অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেশই মা’ এ মন্ত্রে তারা উজ্জীবিত করতে থাকে সবাইকে। যার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি লেখেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে আবেদন, ভিত্তি তা গড়ে ওঠে এ সময়েই। যা আজো চলছ।
মমতা বন্দোপাধ্যায় এ গানের কথা পরিবর্তনের যে আবেদন জানিয়েছেন তা আজগুবি। তবে এর সমালোচনায় আনন্দবাজার যে সম্পাদকীয় লিখেছে তা শঙ্কার।
তারা লিখেছে, ‘বাংলা যে অর্থে এই রাজ্যের সর্বজনীন ঠিকানা, বাঙালিও সেই একই অর্থে রাজ্যবাসীর সার্বজনিক পরিচিতি। ভাষা সেই পরিচিতির গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা, কিন্তু একক মাত্রা নয়। রবীন্দ্রনাথ যে বৃহৎ বাংলা ও বাঙালির সত্তাকে আপন চিন্তায়, সৃষ্টিতে ও কাজে সার্থক করে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে দু’টি শব্দই একে অন্যের দিগন্তপ্রসারী ব্যঞ্জনায় মহিমময়। বস্তুত, বাংলার মাটি বাংলার জল গানটি সেই প্রসারিত বঙ্গচেতনার এক অসামান্য সৃষ্টিরূপ। ইতিহাসের এক কঠিন লগ্নে সম্প্রীতি ও সম্মিলনের আহ্বান হিসাবে এই গানের সৃষ্টি, তার পূর্ণ এবং পুণ্য পরিসরে সবাই সমান ভাবে সমাদরণীয়। বাঙালির প্রাণ এবং বাঙালির মন সেই অবাধ অনাবিল সর্বজনীন পরিসরটিকেই ধারণ করে।’
আনন্দবাজার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সব অধিবাসীকেই বাঙালি বলতে চাইছে ‘সার্বজনিক পরিচিতি’র দোহাই দিয়ে। তারা বলছে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাঙালি নয় (ভাষা সেই পরিচিতির গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা, কিন্তু একক মাত্রা নয়)। তারা বাঙালি সত্তার পরিচয়কে দিগন্তপ্রসারী হিসেবে উল্লেখ করছে এবং একে বঙ্গচেতনা হিসেবে অভিহিত করছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি ছাড়াও সাঁওতাল, মণিপুরিসহ অন্যান্য জাতির লোকজন বসবাস করে আসছে। তারাও নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে রাজি কি না সে বিষয়টি উপেক্ষা করেছে আনন্দবাজার।
মজার বিষয় হলো একজন লেখকের লেখায় হাত দেওয়ার নিয়ম, অধিকার বা সুযোগ কারো নেই। একমাত্র লেখকই লেখার ভাষা বা শব্দ পরিবর্তনের অধিকার রাখেন। মমতা বন্দোপাধ্যায় এসব জানেন না তা সহজে মানা যায় না। তিনি যে আব্দার করেছেন তা বৈধ নয়। তবে তার বক্তব্যের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পরিষ্কার। তিনি সব জাতির মানুষদের বাংলায় আশ্রয় দিতে চান। যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বা রাজ্যের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য।
রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিকে এ প্রেক্ষাপটে দেখলে বলতে হয় সেই আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি ব্যক্ত হয়নি। বঙ্গভঙ্গের সময়েও যা সব জাতি, সব শ্রেণীর মানুষের অধিকারকে সমুন্নত রাখতে পারেনি বলে ইতিহাসে বিভিন্নজন বলে গিয়েছিলেন। যেমন আবুল মনসুর আহমেদ বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষের সমাজ একটা নয়, দুইটা। সে দুইটা সমাজ এক্সক্লুসিভ। তাদের মধ্যে খাওয়া-পরা, বিবাহ-শাদি ইত্যাদি সামাজিক মিল নাই। তাই এগারশ’ বছর এক দেশে বাস করিয়া, একই খাদ্য-পানীয় খাইয়াও তারা দুইটা পৃথক সমাজ রহিয়া গিয়াছে। (…) ফলে এই দুইটা সমাজে দুইটা প্যারালাল কালচার গড়িয়া উঠিয়াছে। জাতীয় কালচার গড়িয়া উঠে নাই। বাংলা ভাগের মধ্যে দুইটা কালচার নিজ নিজ আশ্রয়স্থল খুঁজিয়া পাইয়াছে।’
Discussion about this post