ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, আল-আহলি আরব হাসপাতালের হামলায় কমপক্ষে ৫০০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত- আইসিসির উচিত এই হামলার সুষ্ঠ তদন্ত করা। এতে করে ইসরায়েলে হামলার বিপরীতে ফিলিস্তিনে সংঘটিত নৃশংসতা কতোটুকু, আর ঠিক কে বা কারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তার সুনিদিষ্ট প্রমাণ বের করা যাবে।
যেহেতু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় দিক থেকে বোমা হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন মূল্যায়নের জন্য আইসিসি হতে পারে সর্বোত্তম বিকল্প। এতে এই হামলার জন্য কে দায়ী তার সুরাহা করা যাবে।
আল-আহলি আরব হাসপাতালে বোমা হামলা যে যুদ্ধাপরাধ তাতে কোনো সন্দেহ নেই, শেষ পর্যন্ত যে পক্ষই দায়ী হোক না কেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বলা আছে, সশস্ত্র সংঘাতের সময় বেসামরিক জনগণ, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের কোনোভাবে সামরিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা যাবে না। হোক সেটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিংবা বেপরোয়াভাবে। তার মানে হচ্ছে, আক্রমণকারী জেনে বুঝে বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকবে।
এমনকি হাসপাতাল বা অন্য কোনও বেসামরিক অবকাঠামোগুলিতে সতর্কতা জারি করা হলেও, যে সকল রোগী ও স্বাস্থ্য কর্মী পালাতে অক্ষম বা হাসপাতাল ত্যাগ করতে ইচ্ছুক না তাদের লক্ষ্যবস্তু করা যাবে না। সতর্কতা এমন কোনো জাদুর কাঠি নয় যে, নাগরিকদের আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থাকে ভ্যানিশ করে দেবে।
তাছাড়া ফিলিস্তিনের যে হাসপাতালে রোগীরা আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে হামলা চালানোর কোনোও আইনি ভিত্তি ছিল না। তারা এটাকে নিরাপদ মনে করেছিল।
এর জন্য কোনো এক পক্ষ দায়ী। প্রশ্ন হলো কারা? এই যুদ্ধাপরাধ, এই বিপুল প্রাণহানির জন্য কারা দায়ী? আল-আহলি আরব হাসপাতালে হামলার অসংখ্য পরস্পরবিরোধী অভিযোগ এবং ভুল তথ্যের ছড়াছড়িতে আমরা সত্যকে কীভাবে জানবো?
গাজার কর্মকর্তাদের দাবি, ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতালে বোমা বর্ষণ করেছে। এদিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, হামাসের বিরুদ্ধে আক্রমণের অংশ হিসাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হাসপাতালটি ধ্বংস করেছে, যার অর্থ তারা সেখানে বোমা বর্ষণ করেছে।
কিছু পর্যবেক্ষক ইসরায়েলি বাহিনীর আগের কর্মকাণ্ড স্মরণ করেন এবং এই হামলায় জন্য তাদেরকে দায়ী বলে মনে করেন। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ২৭টি হাসপাতাল ও ৪৪টি মেডিকেল ক্লিনিকের অর্ধেকেরও বেশিতে বোমা বর্ষণ করে। তবে ইসরায়েল আল-আহলি আরব হাসপাতালে বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে, ইসলামিক জিহাদ ভুল করে ওই হাসপাতালের ওপর রকেট নিক্ষেপ করেছে। এদিকে কিছু দেশ ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে, কিন্তু অনেকে এখনো তাদের এই বিবৃতিতে সন্তুষ্ট নয়।
জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধের সাথে সম্পৃক্ত কিনা তা তদন্ত করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে তার নিজস্ব বাহিনী দ্বারা সংঘটিত যে কোনো অপরাধ। তাছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজ নিজ যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি খতিয়ে দেখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং প্রয়োজনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে বলেও উল্লেখ রয়েছে এতে। সমস্যা হলো, যে রাষ্ট্রগুলো নিজেরাই বৈরিতা ও কথিত নৃশংসতায় জড়িত তারা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে সক্ষম বা ইচ্ছুক নয়।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সবসময় হামলার দায় ফিলিস্তিনিদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। বাহিনীটির দাবি, হামাস তাদেরকে বাধ্য করে এই ধরনের হামলা চালাতে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ২০২২ সালের মে মাসে পশ্চিম তীরে জেনিন শরণার্থী শিবিরে প্রতিবেদন করার সময় আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ’র হত্যা। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রথমে দাবি করেন যে, তিনি ফিলিস্তিনিদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পরে তারা এ হত্যার দায় স্বীকার করেন এবং ক্ষমা চান। প্রকৃতপক্ষে একজন ইসরায়েলি স্নাইপার আবু আকলেহকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে। পূর্ব জেরুজালেম, ইসরায়েল ও দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন। তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ইসরায়েলি বাহিনী বৈধতা ছাড়াই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এছাড়া, তদন্তে দেখা গেছে আবু আকলেহের মৃত্যু পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সামরিকীকরণের প্রত্যক্ষ পরিণতি ছিল। সাংবাদিকদের টার্গেট করা যুদ্ধাপরাধ। তবে এই ঘটনায় হত্যাকারীকে কখনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।
এর অর্থ এই নয় যে, আল-আহলি হাসপাতালে প্রাণহানির জন্য ইসরায়েল দায়ী। তবে এ ঘটনায় একটি বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ আইনি ব্যবস্থা কিংবা সংস্থার তদন্ত করা উচিত। যার লক্ষ্য কেবল আগ বাড়িয়ে বিবৃতি দেওয়া নয় যে, এই হামলার জন্য ইসরায়েল অথবা হামাস দায়ী। বরং সুসংগঠিত তদন্তের ভিত্তিতে কে বা কারা দায়ী তা পেশ করা।
এমনকি শক্তিশালী এবং স্বাধীন ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দেশগুলোর মধ্যেও তাদের নিজস্ব যুদ্ধকালীন নৃশংসতা তদন্তের কোনো প্রশংসনীয় রেকর্ড নেই। বলাবাহুল্য, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি ও অভিযোগের স্তরগুলি দুর্গের মতো দুর্ভেদ্য।
প্রায়শই দায়িত্ব উপেক্ষা করা, দোষারোপ করা বা তদন্তে অবহেলা করা, যুদ্ধবাজ দেশগুলোর জন্য সহজ। যেহেতু তারা জনগণের মাঝে যুদ্ধ-সংঘাত জনপ্রিয় করে তোলে এবং সমর্থন পায়। এতে করে তারা খুব সহজে যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধের জবাবদিহিতা এড়াতে পারে।
এটি এমন এক পরিস্থিতি যেখানে প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ও জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের মতো ব্যক্তি গাজা ধ্বংসের জন্য বারবার আহ্বান জানান। কেউ কেউ আবার গণহত্যার উস্কে দেয়। সেই পরিস্থিতিতে তদন্তের ওপর আস্থা রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া ওই ব্যক্তিদের দেওয়া উস্কানিমূলক বিবৃতিগুলি যে কোনোও তদন্তের নিরপেক্ষতা ও ন্যায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলস্বরূপ, এই প্রসঙ্গে তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা গুরুতরভাবে কমে যায়।
এসব হামলার প্রমাণ সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অনুসন্ধানী কমিশন প্রমাণ সংগ্রহ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এটি আল-আহলি আরব হাসপাতালে বোমা হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা বাষ্ট্রকে সরাসরি দোষারোপ করা কিংবা অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকবে।
২০২১ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি নিয়ে তদন্ত করেন। সেই সাথে গাজায় চলমান সংঘাতের পাশাপাশি ইসরায়েলে হামাসসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কোনো ধরনের যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ছিল কিনা তারও তদন্ত করেন।
আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান বলেন, গাজায় যে কোনো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হলে তা তদন্ত করার এখতিয়ার তার রয়েছে।
এটা ভালো যে প্রসিকিউটর অবশেষে ইসরায়েল ও গাজা পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলেছেন। তবে আইসিসিকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। আইসিসি গাজায় সংঘটিত অপরাধের নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত করতে পারে। প্রসিকিউটরের অবিলম্বে ঘোষণা করা উচিত যে তিনি সক্রিয়ভাবে এই তদন্ত পরিচালনা করছেন। ইসরায়েল এবং হাসপাতালের নিকটবর্তী গাজা এলাকায় যারাই দায়িত্বে আছেন তাদের উচিত আইসিসির তদন্তকারীদের নিরাপদে ঘটনাস্থলে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া। যে দেশগুলো মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থক তাদের উচিত ইউক্রেনের মতো মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকট সমাধানেও এগিয়ে আসা।
বলাবাহুল্য, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের নিন্দা জানাতে অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্র ও তাদের নেতারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাছাড়া এই সংঘাতের তদন্ত করতে তারা আইসিসিকেও কোনো ধরনের সহযোগিতা করছে না। উদাহরণস্বরূপ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গাজার সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিকে “মানবিক পরিস্থিতি” বলে অভিহিত করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সংঘাতকে যুদ্ধাপরাধের কারখানা বললে ভুল হবে না, যা ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্ত কি সংঘাতের সমাধান করবে? ফৌজদারি আইন কি সব সত্যের মধ্যস্থতাকারী? অবশ্যই না। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মধ্যেই এর গুরুত্ব। যদিও ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে, অসত্যের জটিলতা কাটিয়ে ওঠার সর্বোত্তম পন্থা হলো একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত। সেই সাথে অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।
আমরা জানি এসব বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা কেবল দায়মুক্তি এবং পরে আরো সহিংসতার জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক আদিল হক লিখেছেন- ‘সবার তদন্ত করুন। হামাস। আইডিএফ। তাদের প্রত্যেকের। যারা সবকিছুর জন্য। দায়ী সবাইকে বিচারের আওতায় আনুন। সবাইকে। ন্যায়বিচারই যথেষ্ট নয়। কিন্তু ন্যায়বিচারই বাকি আছে।’
মার্ক কেরস্টেন ওয়ায়ামো ফাউন্ডেশনের একজন পরামর্শদাতা। তিনি ফ্রেজার ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যান্ড ক্রিমিনোলজির সহকারী অধ্যাপক হিসেবেও কর্মরত
Discussion about this post