মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমার আগ্রহ আজ থেকে নয়। সংবাদমাধ্যমে কাজ শুরু করার পর থেকেই আমি ইরানের বিভিন্ন নিউজ সাইটে তাদের সামরিক অগ্রগতির খবর পড়তাম। পাশাপাশি ইসরায়েলের নিউজ সাইটেও নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করতাম তাদের সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম এবং সিরিয়ায় তাদের হামলা সম্পর্কে জানার জন্য। এ ছাড়া ইয়েমেনের হুতি ও লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এবং তুরস্কের সামরিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো ছিল আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। যখনই গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলে কোনো সংকট চাপিয়ে দেওয়া হয় তখনই মূলত এখানকার নতুন নতুন বিষয় জানার সুযোগ তৈরি হয়।
আজ সন্ধ্যায় ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটির সংজ্ঞা জানার চেষ্টা করছিলাম। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখছি বিশ্বের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটি মুসলমানদের জন্য বরাদ্দ করে ফেলেছে এক প্রকার। আমাদের দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমও একই ধারা অনুসরণ করে চলছে।
মূল কথায় আসি। ৭ অক্টোবরের পর থেকে দিনের অধিকাংশ সময় পার হয় ইসরায়েলের জেরুজালেম পোস্ট ও হারেৎজ— এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের নিউজ পড়ে। সেখানে সব সংবাদেই হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। শুধু তারাই নয়, বিশ্বের বহু নামি সংবাদমাধ্যমও হেঁটেছে এবং হাঁটছে তাদেরই দেখানো পথে। তো, ভাবলাম কেন বিশ্ব জোরপূর্বক হামাসকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে মূলত সেটি একটু খুঁজে দেখি। কিন্তু সংজ্ঞার সঙ্গে হামাসের উদ্দেশ্য ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া এবং তাদের দীর্ঘদিনের কার্যক্রম মিলিয়ে আমি সন্তোষজনক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম না। ফলে ভিন্ন বিষয় নিয়ে খোঁজা শুরু করলাম। তবে আটকে রইলাম ওই হামাস ও গাজায়। দেখতে চাইলাম দখলদার ইসরায়েল যাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিচ্ছে তাদের প্রতি দেশটি এতদিন কী আচরণ করে আসছে। অর্থাৎ, খুঁজে বের করতে চাইলাম, হামাস কি আগ বাড়িয়ে নির্যাতনে নেমেছে নাকি দীর্ঘদিন যে নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনিরা হয়েছেন তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে চেয়েছে। তো, কিছু খুঁজতে চাইলে এখন গুগলই বড় ভরসা। খুঁজতে থাকলাম গাজা ভূখণ্ডকে কীভাবে ইসরায়েল ২০০৭ সাল থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সে বিষয়ে। বেশি সময় লাগল না। কারণ এ বিষয়ে অসংখ্য সংবাদ ও তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খুঁজতে খুঁজতে যা পেলাম তার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় নিচে তুলে ধরলাম আপনাদের জন্য। যার মাধ্যমে আপনারাই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন এ বিষয়ে।
বিমানবন্দর— একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম বিমানবন্দর। কিন্তু গাজার বাসিন্দাদের ভাগ্য খারাপ। তাদের বর্তমানে একটি সচল বিমানবন্দরও নেই। তবে কখনও ছিল না এমনটা নয়। গাজায় মিসরের সীমান্তের খুব কাছেই ছিল একটি বিমানবন্দর। নাম ছিল ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যা ইসরায়েল ২০০১ সালে ধ্বংস করে দেয়। অর্থাৎ সে সময় থেকেই আকাশ পথে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে গাজা।
সমুদ্র বন্দর— বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সমুদ্র। সেখানে গাজার জন্য আশীর্বাদ হতে পারত ভূমধ্যসাগর। কারণ ভূমধ্যসাগরের পাড়েই এ ভূখণ্ড। কিন্তু গাজার নেই কোনো সমুদ্র বন্দর, যার মাধ্যমে তারা বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারবে বা অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। কারণ গাজার নৌযানের নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই; যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল।
স্থলবন্দর— ৭টি স্থল বন্দর রয়েছে গাজার। এগুলোর অধিকাংশই ইসরায়েলের সঙ্গে। এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এগুলোর কপালে কী আছে? এ ক্রসিংগুলোর অধিকাংশই এখন বন্ধ। তবে বর্তমানে রাফাহ ক্রসিং (গাজা ও মিসরের মধ্যে), বেইত হানুন (গাজা ও ইসরায়েল) ও কারিম আবু সালেম ক্রসিং (গাজা, মিসর ও ইসরায়েল) হয়ে যাতায়াত ও বাণিজ্য হয় টুকটাক, তাও ইসরায়েলের মর্জি অনুযায়ী। ফলে, গাজাবাসী ২০০৭ সাল থেকে উন্মুক্ত কারাগারেই বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে চারবার বড় ধরনের আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল। একটি ২০০৮-৯ সালে, যার স্থায়ীত্ব ছিল ২৩ দিন। দ্বিতীয়টি ২০১২ সালে। তৃতীয়টি ২০১৪ সালে এবং চতুর্থটি ২০২১ সালে। প্রতিটি যুদ্ধেই নারী ও শিশু মৃত্যুর হার ছিল লক্ষ্যণীয়। হামলা, নির্যাতন যখন নিত্যদিনের সঙ্গী তখন ৭ অক্টোবর অত্যাধুনিক সীমান্ত দেয়াল ভেঙে অবরুদ্ধ গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রতিনিধি হয়ে হামাস ও ইসলামিক জিহাদ ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে। নজিরবিহীনভাবে ব্যাপক হামলা চালানোর পাশাপাশি তারা ২৪০ জনের মতো সেনা সদস্য ও বেসামরিক নাগরিককে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যায়। লড়াই শুরুর এতদিন হওয়ার পরও তারা সাহসিকতার সঙ্গে টিকে আছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। লক্ষ্য একটাই— গাজাকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করা। তাদের আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতা অর্জন। তাই অনেক সংবাদমাধ্যম ও বিশ্বনেতার চোখে হামাস সন্ত্রাসী হলেও আমি তাদের দেখি স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাওয়া অকুতোভয় যোদ্ধার সমষ্টি হিসেবে।
Discussion about this post