মূল্যস্ফীতি বলতে এমন একটি অবস্থা বোঝায় যেখানে একই পরিমাণ দ্রব্য বা সেবা ক্রয় করতে আগের তুলনায় বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি হলে অর্থের মূল্য কমে যায়। সাধারণত, কোনো একটি দেশের অর্থনীতিতে অর্থের জোগান বৃদ্ধির ফলে দ্রব্য সামগ্রীর কার্যকর চাহিদা বাড়ে, সে তুলনায় দ্রব্য ও সেবার উৎপাদন যদি না বাড়ে, তখন দেশের সামগ্রিক দামস্তর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলে, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে এবং অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়।
মূল্যস্ফীতি ধনী, মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র—সবার জন্য এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ। উচ্চবিত্তের জন্য মূল্যস্ফীতি হয়তো বিরক্তির বিষয়; কিন্তু মধ্যবিত্তের, শহর ও গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের জন্য মূল্যস্ফীতি বড় সংকট তৈরি করে। মূল্যস্ফীতির কারণে আপস করতে হয় পুষ্টিতে—মাছ, মাংস, ডিম উধাও হয় সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকা থেকে।
সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২.৫৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে খাদ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের অক্টোবরে, ১২.৮২ শতাংশ। গড় মুদ্রাস্ফীতি ২৩ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে যাওয়ার কারণে ৯.৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায়, ১২.৭১ শতাংশ। গত জুলাইতে এটি ছিল ৯.৮২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪০ শতাংশ। এমন এক সময়ে এই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে যখন আশেপাশের দেশসহ সারা বিশ্বে এটি কমে আসছে। মূল্যস্ফীতি হারের ঊর্ধ্বমুখিতায় নিত্যপণ্যের বাজারে সৃষ্ট উত্তাপে দেশের সাধারণ মানুষ দিশেহারা। দেশে মূল্যস্ফীতির হারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণ এবং এর ফলে মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। অবশ্য ওই সময় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৪৪ শতাংশ, যা আগস্টে ৭ শতাংশে নেমে আসে। অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৯.৮ শতাংশ, যা চলতি বছরের জুলাইয়ে ৬.৩ শতাংশে নেমে আসে মর্মে দেশটির স্ট্যাটিস্টিকস ডিপার্টমেন্ট নিশ্চিত করেছে। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, আগস্টে এ হার ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। নেপালের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুনে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.৮৩ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময় ছিল ৮.৫৬ শতাংশ। ব্যাংক অব থাইল্যান্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কিছু ওপরে আটকে রাখতে সক্ষম হয় থাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছর আরও নিয়ন্ত্রিত অবস্থানে চলে এসেছে দেশটির মূল্যস্ফীতি। ২০২৩ সাল শেষে থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার আড়াই শতাংশে থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বিপরীতক্রমে, আমাদের খাদ্যে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী নভেম্বরের আগে দেশে এ হার কমছে না। শীতের শাকসবজি বাজারে এলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমতে শুরু করবে বলে আশা করা যায়।
মূল্যস্ফীতি মূলত তিনটি কারণে ঘটে থাকে। এগুলো হলো ডিমান্ড পুল (অত্যধিক চাহিদা), কস্ট পুশ (খরচের ঊর্ধ্বমুখিতা) এবং সরকার নির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধি জনিত। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে এ তিন ধরনের উপাদানই রয়েছে—রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নেওয়া (অত্যধিক চাহিদা), ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস (খরচের ঊর্ধ্বমুখিতা) এবং পরিবহন জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি (সরকার নির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধি)।
মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে কিছুটা প্রশমন করতে হবে। সেটা করার অস্ত্র সরকারের হাতেই আছে। একটি হলো বাজেট, অন্যটা মুদ্রানীতি। বাজেটে এবার অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্ষেত্রে যে শক্তিশালী প্রবণতা আছে, সেটিতে নতুন করে কিছু যোগ করা যাবে না। এর অর্থ হচ্ছে সম্প্রসারণমূলক বাজেটে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ এবার নেই। বাজেটে যে ঘাটতি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, তার তুলনায় ঘাটতি বাজেটটা কম হতে হবে। এছাড়াও সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্রেডিট রেটিং অবনমনের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য বাংলাদেশকে সুশাসন, নিয়মতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতা আনার জন্য কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে—মুদ্রার মান, সুদের হার নির্ধারণ পর্যায়ক্রমে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাঁটাই করতে হবে। প্রকল্প ব্যয় সীমিত করা ও সময়মতো বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।
নীতিনির্ধারকদের মাথা থেকে ‘মূল্যস্ফীতি আমদানি করা’—এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে মূল্যস্ফীতির কারণ প্রধানত দেশীয়, এটা স্বীকার করতে হবে। তাই রাজস্ব আয় বাড়িয়ে সরকারের ঋণ কমাতে হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভ্যাটের মতো মূল্যস্ফীতি ঘটায় এমন করের পরিবর্তে আয়করের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। মেগা প্রকল্প ও উচ্চ মূল্যের বিদেশি ঋণের আসক্তি কমাতে হবে।
আমদানি করা পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে রি–অ্যাক্টিভের (প্রতিক্রিয়াশীল) পরিবর্তে প্রো–অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) ভূমিকা নিতে হবে। পণ্য বাজারে সংকট শুরুর আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তাছাড়া সড়ক, নৌপথ ও হাটবাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচারকারী, চাঁদাবাজ, শুল্ক ও কর ফাঁকিতে নিয়োজিত ব্যবসায়ী ও তাঁদের সঙ্গে যোগসাজশকারী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধানত তিনটি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, আর্থিক ব্যবস্থা, রাজস্বসংক্রান্ত ব্যবস্থা এবং প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। আর্থিক ব্যবস্থা : মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি দূর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমাতে হবে। অর্থের পরিমাণ কমাতে হলে ব্যাংকসৃষ্ট ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে। কারণ, বর্তমান অর্থ ব্যবস্হায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে বহু লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রত্যেক দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান উপায় হলো ব্যাংক হার বৃদ্ধি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংককে টাকা ধার দেয় তাকে ব্যাংক হার বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক হার বাড়ালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও তাদের সুদের হার সাধারণত বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে এবং ঋণের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এভাবে মুদ্রাস্ফীতির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক হার বাড়িয়ে দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যাংক সৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে। এরূপভাবে ঋণপত্র বিক্রয় করলে ক্রেতারা তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর চেক কেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাওনা মিটিয়ে থাকে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রয় করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের রিজার্ভের হার পরিবর্তন, নৈতিক চাপ প্রয়োগ, প্রত্যক্ষ ঋণ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির সাহায্যে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রাস্ফীতি দূর করার চেষ্টা করে। মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে আরো পিষ্ট হবে দেশের সাধারণ মানুষ এবং সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।
Discussion about this post