অগোচরা দেখলাম। যদিও দেখার পর পড়ার আগ্রহ আরো বেড়ে গেছে। সময়ের আলোচিত লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের উপন্যাস অগোচরা নিয়ে বিঞ্জ ওটিটিতে দেখলাম সিরিজ অগোচরা। ফেসবুক টাইমলাইনে এ সিরিজ নিয়ে অনেকের লেখাই চোখে পড়ছিল। সেই থেকে আগ্রহ। অবশ্য পুরান ঢাকা আশি এবং তার পরের দশকে কেমন ছিল তা জানতে কৌতূহল আমার সবসময় ছিল। সেই কৌতূহল মেটাতে বিঞ্জেতে লগইন ছাড়াই প্রথম পর্ব ফ্রিতে দেখে নিলাম। পরে টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হলো। সে জন্য এয়ারটেল বা রবি সিমের প্রয়োজন। এ দুই সিম থেকে সাত টাকায় চব্বিশ ঘণ্টার একটা প্যাকেজ কেনা যায়। আমার কাছে কোনো সিমই ছিল না। এক বন্ধুর সিমের টাকা ধার করে দেখলাম অগোচরা।
এর নির্মাতা সিদ্দিক আহমেদ। পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের গল্প এটি। একজন সাধারণ ছেলে পলিটিকসের শিকার হয়ে কীভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে জড়িয়ে পড়ে, তা নিয়েই সিরিজ। জাকিয়া বারী মম ও ইমতিয়াজ বর্ষণ ছাড়াও এতে অভিনয় করেছেন ইন্তেখাব দিনার, ফজলুর রহমান বাবু, শরাফ আহমেদ জীবন, মোরশেদ মিশু।
সিরজের নামটা অগোচরা কেন হলো তা দেখার সময় বারবার আমি ভেবেছি। শেষে গিয়ে গেসু যখন সামাদকে বলে, ও তুমি অগোচরে থাকতে চাও। তখন মনে হয়েছে, এই সামাদ অগোচরা। ছিল আলাভোলা, প্রেম করে বেড়ানো একটা ছেলে। পরে সে হয়ে উঠল আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রধান। নিজের বসের বিধবা পত্নীরও দখল নিয়ে নিল। তার আগে ঘটল অনেক ঘটনা, খুন, নানা মারপ্যাচ।
ইঙ্গিতে বোঝা যায় তখন এরশাদের শাসনামল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। বাংলা সিনেমার রমরমা যুগ। সিনেমা, মদ, গাজা, জুয়া, অস্ত্র, এলাকার বড়ভাই-ছোটভাই কালচার। রাজনৈতিক দল মানে পুরান ঢাকায় তখন এইসব কারবার। কে কাকে দমন করে নিজে পদ বাগাবে সেই অরাজকতা। যোগ্যতা নাই তবু মন্ত্রীর ভাতিজা সাফ গেমসের শ্যুটিংয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। আর সামাদ, শ্যুটিংয়ে তার দারুণ প্রতিভা। মন্ত্রীর ভাতিজার সঙ্গে না পেরে সে তার প্রতিভা কাজে লাগালো আন্ডারওয়ার্ল্ডে। একের পর এক মানুষ খুন করে। কিন্তু রক্ত সহ্য করতে পারত না যে সামাদ, সে এত সহজে খুনি হয় কী করে? সামাদের অগোচরে থাকা তার নিজের ভেতরের আরেক সামাদ হাজির হয় তখন দর্শকের সামনে। তারা বাহাস করে নৈতিকতা, লোভ, মনুষ্যত্ব এসব নিয়ে।
পরে সরল সামাদ হেরে যায়। জীবনের অগোচরে থাকা আরেক সত্যকে সে মেনে নেয়। অন্যকে না দমন করতে পারলে নিজের উন্নতিও হয় না, অস্তিত্বও টিকে থাকে না।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ম হলো সবসময় অগোচরে থেকে যায় কেউ। কাউকে বিশ্বাস করতে হয় না। নিজের স্ত্রীকেও না। যাকে কলিজার টুকরা করে রাখা হয়, সে ছুরি বসিয়ে দেয় পিঠে।
ঢাকা শহর বেড়ে ওঠার অগোচরে খুন, মাস্তানি, দখল- এসবের বিরাট ভূমিকা আছে। এখনকার ঢাকা সামাজিক, রাজনৈতিক যে আদল পেয়েছে, তাতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিরাট অবদান। এই সত্যটা নাজিম উদ্দিনের মাধ্যমে দেখতে পেলাম।
একজন এটাকে বাংলাদেশের সেরা সিরিজ বলেছেন। আমি তার সঙ্গে খুব বেশি তর্কে যাব না। ম্যাচুরিটির দিক থেকে অগোচরা প্রথম তিন-চারটা বাংলাদেশি সিরিজের ভেতরেই থাকবে।
তবে সিরিজটায় সংলাপের আধিক্য আছে। যদিও অনেক সংলাপ উপভোগ্য। সম্ভবত সংলাপ দিয়ে তখনকার পুরান ঢাকাকে বিস্তৃত আকারে বুঝানোর সহজ কৌশল বেছে নেয়া হয়েছে। যে কারণে উপন্যাস অগোচরা পড়ার আগ্রহ বেড়ে গেছে। নাজিম উদ্দিনের লোভনীয় বর্ণনায় নিশ্চয় পুরান ঢাকাকে আরো ভালোভাবে পাওয়া যাবে।
রেট দিতে হলে আমি অগোচরাকে দশে সাত দেব।
Discussion about this post