স্যান্ডি সাহা নামটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে গত পরশু, সোশ্যাল মিডিয়ার রিলসের মাধ্যমে। স্যান্ডি ভারতের কলকাতার মানুষ, কনটেন্ট ক্রিয়েটর। তার সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি কেবল ‘ছ্যাবলামো’র জন্যই। তিনি নিজেও তা স্বীকার করে ফেসবুক পেইজে লিখে রেখেছেন, আমার কোন ট্যালেন্ট নেই, ছ্যাবলামো করে ফেমাস হচ্ছি। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সফর করে গেছেন। ঢাকার কিছু মানুষ কলকাতাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে এক ধরনের শ্লাঘা বোধ করেন। তারা বোঝেনই না, কলকাতাকে লঘু করবার প্রয়োজন ঢাকার নেই।
মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকায় এসে কনসার্ট করে গেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, বাংলা ভাষার গান, কবিতা ও সিনেমার অন্যতম প্রতিভাধর শিল্পী অঞ্জন দত্ত। অঞ্জন দত্তর এই ঢাকা সফর নিয়েও সমালোচকরা সরব ছিলেন। তবে এই লেখার বিষয় কলকাতা বা অঞ্জন দত্ত নন, বরং স্যান্ডি সাহা। এই তারকা যেহেতু ঠিক মূলধারার নন, তাই তাকে নিয়ে ঢাকার লোকেরা তেমন উচ্চবাচ্য করেননি।
সুশীল রুচির দাঁড়িপাল্লায় মাপলে স্যান্ডি, যার আসল নাম সন্দীপ, হয়তো কেবল অনেক চিন্তকের হিসেব থেকেই বাদ পড়বেন। কিন্তু তার প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আগ্রহ হওয়ায় খুঁজে খুঁজে তার সাক্ষাৎকার, ঢাকায় ঘোরাঘুরির ভিডিও এবং আগের কিছু কাজকর্ম দেখলাম। আবিষ্কার করলাম, এই তথাকথিত ‘ট্যালেন্টবিহীন’ সেলিব্রিটির অর্থহীন বা অ্যাবসার্ড কাজকর্মের ভেতরে এমন অনেক বার্তা রয়েছে যা জরুরি, তবে সেসবকে পাঠ করতে হবে সাবধানে।
স্বীকার করতেই হবে, স্যান্ডি যা বলেন এবং করেন সেসব নেওয়া বেশ কঠিন। অনেক আবোল-তাবোল কাজকর্ম করে তিনি নিজের দেশেও আইনের আওতায় এসেছেন। তবে তা তার কনটেন্টের জন্য নয়, যে কোন দেশেই রেললাইনে ও মেট্রোরেলে ভিডিও করা নিয়ে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা থাকে, যা তিনি জানতেন না। রেলওয়ে থেকে দস্তুরমতো অনুমতি নিয়ে সিনেমার শুটিং করতে হয়, কেননা আমাদের এদিকে ব্রিটিশ আমল থেকেই স্টেশন, রেললাইন ইত্যদি যে সমস্ত স্থানে থাকে, তার ভূমির মালিকানা থাকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
যা বলছিলাম, স্যান্ডির কাজকর্ম মেনে নেওয়া কঠিন। উদাহরণ দিচ্ছি, একটি ভিডিওতে দেখা যায় তিনি বিকিনি ধরনের পোশাক পরে ঘোড়ায় চেপে চলেছেন শহরের রাস্তায়। তার পোশাকটি তৈরি করা হয়েছে একটি ট্যাবু প্রডাক্ট দিয়ে। প্রথম দেখে আমি নিজেও বুঝতে পারিনি পোশাকের মেটিরিয়ালটা কী? ভেবেছি এমনিতেই মজা করার জন্য উদ্ভট পোশাক পরেছেন। পরে তার কথাবার্তা শুনে লক্ষ্য করে দেখি, এ কী! তার ঊর্ধ্বাঙ্গে বক্ষবন্ধনী, গলার মালা, নিম্নাঙ্গের আবরণ- সব কিছুই বানানো হয়েছে কনডম দিয়ে!
কিন্তু স্যান্ডির কোনো বিকার নেই। তিনি পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটি সদ্য কৈশোর পার হওয়া ছেলেকে বলে বসলেন, লাগলে তিনি তাকে দুই একটা দিতেও পারেন, কাজে লাগবে! যৌনতা আমাদের উপমহাদেশে এমন এক ট্যাবু যা ভাঙতে হয়তো লেগে যেতে পারে আর একটা শতাব্দী। এ প্রশ্নে আমরা প্রায় ভিক্টোরিয়ান আমলেই পড়ে আছি। এমনকি নারীর মাসিকের মতন একটি জরুরি প্রজনন স্বাস্থ্য ইস্যুকেও যৌনতা হিসেবে দেখে আমাদের সমাজ ও সময়। ভারতেরই কোন এক টেলিভিশন চ্যানেলে অনেক বছর আগে একটি সচেতনতামূলক প্রচারণা দেখেছিলাম। দুই নারীর মধ্যে কথা হচ্ছে, একজন গৃহকর্মী আর একজন গৃহকর্ত্রী। কর্মী কাপড় কাচতে গিয়ে একটা জিনসের প্যান্টের পকেটে কিছু জিনিস পেয়ে কর্ত্রীর কাছে জমা দেন। গৃহিণী আগুন হয়ে বলেন, ও আবার ওর ভাইয়ার বাইকের চাবি নিয়েছে! আজ আসুক ওর ভাই – ইত্যাদি বলে অনুপস্থিত দেওরের ওপর রাগ ঝাড়তে থাকেন। গৃহকর্মী নারীটি তখন আর একটা জিনিসের দিকে মালকিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনি হেসে ফেলে বলেন, ‘আরে ওটা কিছু না! অল্পবয়সের ছেলের পকেটে এসব থাকবেই!’
বলাবাহুল্য এই ভূখণ্ডে সমাজ ও পরিবার এত উদার নয়। অবিবাহিত ছেলের পকেটে রিভলভার বা গাঁজা পেলেও যে পরিবার মেনে নেবে, ধামাচাপা দেবে, কনডম পেলে সেই পরিবারই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে দ্বিধা বোধ করবে না। যে কারণে প্রয়োজন পড়ে এই সকল প্রচারণার।
বাংলাদেশের এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় স্যান্ডিকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি সমকামীতাকে উৎসাহ দিচ্ছেন না!’ মিষ্টি হেসে তারকা উত্তর দিলেন, ‘ভারতে সমকামীতা লিগ্যাল।’ আমাদের চোখে যতই আপত্তিকর হোক, নিজের অবস্থানে থেকে ঠিক কথাটাই বলেছেন অল্প বয়সী এই সেলিব্রিটি। অত্যন্ত তাফালিং মার্কা ওই ভিডিওটিকে তার দায়িত্বশীলতার প্রমাণ হিসেবেই দেখেছি আমি।
ঢাকায় এসে করা ভিডিওগুলোর মধ্যে এই ধরনের আরও কনটেন্ট রয়েছে। যেমন- সঙ্গে একজন বাংলাদেশী কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে নিয়ে পাবলিককে প্র্যাঙ্ক করে তিনি দেখিয়েছেন, ঢাকার লোকজন হিন্দু হোটেল খুঁজলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়, বিদেশী ও অন্য ধর্মের অতিথিদের প্রতি তারা কতখানি সহানুভূতিশীল এবং অতিথিপরায়ণ। বলা বাহুল্য, ঢাকার বাইরে পুরো বাংলাদেশের অবস্থা একই রকমের নয়।
আমাদের চারপাশেই বিষমকামীতা, একগামী ও একমাত্র বিবাহ সম্পর্ককে মহান করার চর্চা আছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় দুই ইয়ংস্টার মুনজেরিন এবং আয়মানের বিয়ে ও বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচুর চর্চার পর এমন এক রিল দেখলাম যা একই সঙ্গে হাস্যকর ও হতাশাজনক ঠেকলো আমার চোখে। ভিডিওর শিরোনাম, আয়মানের ঠোঁটে মুনজেরিনের লাভ বাইট! আমি আক্ষরিক অর্থেই হা হয়ে রইলাম দেখে। এই প্রজন্ম কি আসলেই বিশ্বাস করে যে কয়েক বছর ধরে সম্পর্কে থাকা কোনো যুগল কেবল বিয়ের পরই যৌনপ্রেমে লিপ্ত হয়! তার আগে নয়! উল্লিখিত দম্পতির ক্ষেত্রে এই শুচিতার ধারণা যদি সত্য হয়ও, তা কি একটা ভিডিও তৈরি করবার মতন খবর বা বিষয়!
সেক্সুয়াল প্রেফারেন্স এবং জেন্ডার আইডেনটিটির প্রসঙ্গে বাইনারি অপোজিশন থেকে বের হওয়ার সময় চলে এসেছে। একলা বয়স্ক মহিলা দেখলেই, ‘ভাবী, আমাদের ভাই কী করেন?’- জাতীয় প্রশ্নকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখার সময়ও শেষ। মানুষের সঙ্গী নির্বাচন, একগামীতা, বহুগামীতা, সমকামীতা, বিষমকামীতা ইত্যাদির প্রকাশকে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে দেখতে পারতে হবে। আমাদের দেশের তারকারা যেখানে মিডিয়া মাতিয়ে রেখেছেন গোপন ও প্রকাশ্য বিবাহ, সন্তান জন্মদান ও সেক্সুয়াল জেলাসির খবর দিয়ে; এ দেশের উচ্চ আদালত যখন শুধু মায়ের নামে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করবার মতন সুন্দর বিধান দিচ্ছেন, সে সময়েও আগে অস্বীকার করা সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করানোর সময় কেবল উপস্থিত থেকে পিতৃত্বের মাহাত্ম্য কিনে নিচ্ছেন এক সুপার স্টার, সঙ্গে সঙ্গত করছেন স্ত্রীর মর্যাদার জন্য লালায়িত দুই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী- এই রকম সময়ে স্যান্ডি সাহার ওই সংলাপ- শাকিব খানের তিন নম্বর বউ আমিই হবো- তা শক্ত চপেটাঘাতই বটে। স্যান্ডি সাহার তৈরি করা হাস্যরস, মনের মধ্যে প্রেমের উদার জমিনের ঘোষণা, পুরুষ শরীরে নারীর মন নিয়ে সম্মানের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়ানো অনেক কিছু ভাঙ্গাগড়ার বার্তা দেয়!
Discussion about this post