নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ইয়ন ফস্সে তার লেখালেখির জন্য এবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনি প্রায় অচেনাই ছিলেন বলা যায়। যুক্তরাজ্যে তার নাটক মঞ্চায়িত হওয়া সত্ত্বেও সেখানেও তিনি অনেকটা অপরিচিত ছিলেন দীর্ঘকাল। অ্যান্ড্রিউ ডিকসনের সঙ্গে তিনি এই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। ২০১৩ সালে তার নাম প্রথম নোবেল পুরস্কারের তালিকায় উঠেছিল বলে খবর ছড়িয়েছিল। ২০১৩ সালে পুরস্কার পেয়েছিলেন লেখক এলিস মনরো। নিজের লেখালেখি ও মনোজগতের অনেক কিছু নিয়ে তিনি কথা বলেছেন এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে। সম্প্রতি সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
তিনি ইউরোপের সবচেয়ে বহুল মঞ্চায়িত নাট্যকারদের একজন। তার অভিনব, পিন্টারেস্ক (নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টারের নাটকের মতো রহস্যময় শৈলী, হ্যারল্ড পিন্টারের নাটকগুলোকে কোনো আঙ্গিকে ফেলতে না পেরে এই শব্দটি সৃষ্টি করা হয়েছে) নাটকের জন্য তিনি এবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন। কিন্তু, বিট্রেনেও অনেকে তাকে তেমনভাবে চেনে না। এখানে তিনি কথা বলেছেন তার নাট্যকারজীবন নিয়ে, এবং কেন সেই জীবনের ইতি টানতে পারেন তা নিয়েও।
অসলো হোটেলের হলরুমের সামনে ইয়ন ফোস্সের সঙ্গে আমার দেখা। কনুই ধরে তিনি আমাকে সামনের ডেস্কের দিকে নিয়ে গেলেন। সেখানকার দেয়ালে কোনো লেখার একটা প্যরাগ্রাফ আটকে রাখা। তিনি বলেন, “আমার উপন্যাসের অংশ।” তারপর ফিসফিসিয়ে বলেন, “ওপরে আমার নামে পুরো একটি স্যুট বরাদ্দ”। তিনি কি রোমাঞ্চিত না হতাশ বোঝা গেল না।
সব নাট্যকারই যে নিজের নামে স্যুট বরাদ্দ পান তা নয়, বিশেষ করে তারা যখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু, ফস্সে সাধারণ নাট্যকার নন। তিনি নরওয়ের বিখ্যাত লেখকদের একজন। সম্ভবত ইউরোপের জীবন্ত নাট্যকারদের মধ্যে তার নাটকই সবচেয়ে বেশি মঞ্চায়িত হয়েছে। ৪০টির বেশি ভাষায় তার লেখা নাটক অনূদিত হয়েছে। ২০১০ সালে তিনি গ্লোব থিয়েটারের সবচেয়ে বড় পুরস্কার- ইবনেস পুরস্কারটি অর্জন করেন, যার মূল্যমান ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড। গত বছর অর্জন করেন ফ্রান্সের ন্যাশনাল অর্ডার অফ মেরিট। গত অক্টোবরে, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল যে ২০১৩ সালটা ফস্সের বছর হতে যাচ্ছে (এর পরিবর্তে এটা এলিস মনরোর বছর হয়েছিল)।
কাছাকাছি একটি ক্যাফেতে বসে পরিস্থিতি বুঝে আমি বলি, হোটেলে আপনার নিজের একটা স্যুট থাকাই উচিত। ক্ষমাপ্রার্থীর ভঙ্গিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন এটা তিনি কখনো ব্যবহার করেননি। নরওয়ের রাজপরিবারের সৌজন্যে কাছেই তার জন্য একটা সরকারি বাড়ি আছে।
তবে, একটি দেশ ফস্সের প্রতিভার দ্যুতি থেকে একগুঁয়েভাবে অচ্ছুত রয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য। লন্ডনে বৃহৎ কলেবরে তার শেষ নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল ২০১১ সালে। ‘আই এ্যাম দ্য উইন্ড’ নাটকটির পরিচালক ছিলেন ফ্রান্সের পরিচালক প্যাট্রিস শেরিউ। তার কিছু রিভিউ হয়েছিল, কিন্তু, সেগুলো এতই নিরুত্তাপময় যে প্রায় নিরবতার পর্যায়েই পড়ে। নয় বছর আগে রাজদরবারে ক্যাটি মিচেলের পরিচালনায় ‘রাতের গান’ নাটকটি এতই অসফল হয়েছিল যে মিচেল পর্যন্ত তা ব্যর্থ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
তার নাটকে ঠিক কী বলা হয়, তা নিয়ে ব্রিটিশ সমালোচকরা বিভ্রান্ত। এমন কি তার ভক্তরাও বুঝতে পারেন না তিনি কী বলতে চাচ্ছেন। স্বাধীন সমালোচকেরা, যারা ‘আই এ্যাম দ্য উইন্ড’ দেখে বলেছেন এমন নাটক আর দেখেননি, তারাও বলেছেন, “ইয়ন ফস্সের নাটক দেখে কিছু বুঝেছি কি না এ-নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।”
তার ‘মৃত কুকুর’ নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ২০০৫ সালে, যুক্তরাজ্যে এটি প্রথম মঞ্চায়ন হতে যাচ্ছে সামনে, মায়ের ফ্ল্যাটে থাকা এক যুবকের অসুখী গল্প, নতুন করে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। সমালোচকরা কী বললেন এ নিয়ে ফস্সের মাথাব্যাথা নেই। তবু বললেন, হয়তো ভবিষ্যতে ব্রিটিশ মঞ্চে তিনি নিজের জায়গা পাবেন। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় ভিন্নতার কারণেই এই ভয়। অন্যদের দূরে সরিয়ে রাখলে তোমার নিজের থিয়েটার অনন্য হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলে জার্মানি জিতে গেলেও তুমি ভাবো যে তোমরাই সেরা, কারণ, তোমরা এটা আবিষ্কার করেছ। এটা একটা নির্বুদ্ধিতার ব্যাপার।”
যাই হোক, হয়তো বুঝতে না পারাটাই তাকে দূরে সরিয়ে রাখার মূল কারণ নয়। জেদ ও উদ্যোগের বশেই তিনি কাজের পর কাজ করে গেছেন- তার মোট নাটকের সংখ্যা ৩০টির ওপর, কালে কালে সংযোজনের ফলে সেগুলোর কলেবরও বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে, নাটকের মতো তার উপন্যাস আর প্রবন্ধগুলোও- অর্থ উদ্ধারের জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছে। তার প্রথম নাটক- ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম’ (১৯৯৫), এক দম্পতিকে নিয়ে লেখা গল্প, যারা মাত্র এক জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকতে এসেছে: বাড়িতে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে নারীটি ভয়ে অসাড়, আর অন্যদিকে পুরুষটি ঈর্ষায় কাতর। তাদের কথোপকথন কেমন আলগা আলগা, ঘনিষ্ঠ, কিন্তু, কখনোই সম্পূর্ণ সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় না।
পরবর্তী ট্রিলজির বৈশিষ্ট্যও অনেকটা গ্রীষ্ম, শরৎ আর শীত ঘিরে রচিত। প্রথম অংশে এক মহিলার একদিনের টুকরো টুকরো দৃশ্য জোড়া লাগানো, সেদিনই তার স্বামী সমুদ্রে হারিয়ে গেছে। দ্বিতীয় অংশে, কবরখানায় দেখা হয় দুই আগন্তুকের, যদিও তারা কোনোভাবে জীবনকাল ধরেই পরিচিত। তৃতীয়টি এক বেশ্যা আর ব্যবসায়ী সম্পর্কে, ভুল আকাঙ্ক্ষা আর দ্বিমুখী উদ্দেশ্যের এক জটিল ঐকতান, এক অসাড় ভাষায় রূপ দিয়েছে। “এটা ওটার মতো না,” নারীটি বলে যখন পুরুষটি তাদের একসাথে চলে যাবার পরামর্শ দেয়, পুরুষটি বলে, “সবই ওটার মতো।”
ভারি নিরবতা আর বিচ্ছিন্ন সংলাপের কারণে তার কিছু নাটক বেকেটের কথা মনে করিয়ে দেয়, কিছু মনে করিয়ে দেয় পিন্টারের কথা। ফস্সেও এই মিলের কথা স্বীকার করেন। “পিন্টার বলেছেন তার নাটকগুলো যোগাযোগের অভাব নিয়ে নয়, বরং খুব বেশি যোগাযোগের চেষ্টা নিয়েই, আমিও একই কথা বলব : আমার চরিত্রগুলো শব্দ ছাড়াই যোগাযোগ করে। তারা এর মধ্যেই জানে কী বলতে হবে।”
অনেক দিন ধরেই তার নাম ইবসেনের সঙ্গে উচ্চারণ করা হয়। তিনি কাঁধ ঝাঁকান, “যখন থেকে আমার নাটক বিদেশে মঞ্চায়ন হতে শুরু করলো তারা এ কথা বলতে শুরু করল। আমার যুৎসতই উত্তর ছিল, এটা যেমন ইবসেনের জন্য অবমাননাকর, আমার জন্যও।”
এখন তার বয়স ৫৪ (সাক্ষাৎকারটি ১০ বছর আগের), নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে হৌগসুন্ডের কাছে নিজর্ন এক ফার্মে ফস্সে জন্মগ্রহণ করেছেন। এখন তিনি অস্ট্রিয়া আর অসলোতে ভাগাভাগি করে থাকেন। হৌগসুন্ডেতে তার একটা কটেজ আছে এখনো। যদিও সেটা কোথায় বলা মুশকিল। প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রতি তার অদম্য টান (এগুলো হলো- কটেজে গিয়ে মাছ ধরা, নির্জন গ্রামে হারিয়ে যাওয়া, আর বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রা)। এসব তার লেখার মধ্যেও পাওয়া যায়। এগুলো তো আত্মজৈবনিক? “অবশ্যই। কিন্তু, কল্পনারও মিশেল, বাস্তব ও কল্পনা, দুটোই। সমুদ্রজ্ঞান ছাড়া ‘আই এ্যাম দ্য উইন্ড’-এর মতো নাটক আমি লিখতে পারতাম না। কিন্তু, নাটকের জগত তো তৈরি হয় শূন্য থেকে। শুরু করার আগে আমি কিছু না জানাই পছন্দ করি। লেখালেখিকে আমি কিছু শোনার সাথে তুলনা করি। আমি ঠিক জানি না একটু পর আমি কী শুনব। কিন্তু, যেভাবেই হোক আমি শুনতে চাই, আমি কান পেতে থাকি।”
ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজের পরিচিতি গড়ে তোলার পর ৩০ বছর বয়সে ফস্সে থিয়েটারের প্রতি মনোযোগী হন। অনেক সময়ই বোঝা যায় না তার নাটকগুলো নাটক নাকি কবিতার চেয়ে বেশি কিছু। এটাই তার নাটকের প্রতি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। এই সম্মিলনকে তিনি একবার ‘গ্রুপ সেক্স’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এর মানে কী? তিনি হাসেন। “এটা লেখার প্রক্রিয়ার চেয়ে বেশি কিছু। আমি আমার লেখায় স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য চাই। যখন আমি থিয়েটারের জন্য লিখতে শুরু করি, এটা কীভাবে সামলাবো ভেবে অবাক হই, এবং সিদ্ধান্ত নেই আমি এটা পারবো না, তাই একে নিজের মতো যেতে দিয়েছিলাম। কিন্তু, থিয়েটারে সর্বোত্তমভাবে পবিত্র কিছু রয়েছে। এটা গ্রুপ সেক্সের চেয়ে পবিত্র কিছু। অন্তত যে ধরনের থিয়েটার আমি পছন্দ করি।”
মানুষের বৈশিষ্ট্য থাকলেও মাঝে মাঝে ফস্সের ওপর শয়তান ভর করে। আমার মনে হয়, এটি তার নাটকের খামতির অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে। তিনি তার কফির কাপ ভরলেন। “লেখালেখি আমার টিকে থাকার একটা পথ।” অবশেষে তিনি বলেন। “খুব অল্প বয়সেই আমি লিখতে শুরু করি। যখন আমার ১২ বছর বয়স তখন ছোট ছোট কবিতা লিখতাম। ছোট গল্প লিখতাম। লেখালেখির মাধ্যমে দুনিয়াতে আমার নিজস্ব একটা জায়গা করে নিয়েছিলাম, যেখানে আমি নিরাপদ বোধ করতাম। এটা এক প্রকার পলায়নবৃত্তি।” এক শয়তানের হাত থেকে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন। মদ্যপান। দুবছর আগে হঠাৎ করেই এর থেকে নিষ্কৃতি পান, এলকোহল বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর। এর পর থেকে আর এক ফোঁটাও ছুঁয়ে দেখেননি। তার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। “আমার বৈবাহিক সম্পর্ক দীর্ঘকাল বহাল ছিল। কিন্তু, এখন এটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে।”
সম্প্রতি তিনি আবার বিয়ে করেছেন। তৃতীয়বারের মতো। তিন দশকের ভয়াবহ কর্মযজ্ঞের পর এখন তিনি কিছুটা কমই লিখতে চান। লিখতে চান আরো ধীরে। এমনও কানাঘুঁষা শোনা যায় যে তিনি থিয়েটার একেবারেই ছেড়ে দেবেন। এটা কি সত্য? “ওহ, হ্যাঁ” তিনি বলেন। “এর মধ্যে ছেড়েই দিয়েছি বলা যায়।” সত্যি? আদৌ আর কোনো নতুন নাটক নেই? তিনি কাঁধ ঝাঁকান। “আরেকটি নাটক লেখার ভাবনা আমাকে কোনো আনন্দ দেয় না।” বাতাসে তার আঙুল চলে। “বিশ বছর, ১৯৯৪ থেকে ২০১৪, এডাপটেশনসহ প্রায় ৪০টি নাটক লিখেছি। যথেষ্ট হয়েছে।”
তার ওপর নোবেল পুরস্কারের আলো এসে পড়েছে, জানতে ইচ্ছে করে তার কী অভিমত, তার কি এটা পাওয়া উচিত। তিনি শ্বাস ফেলেন। “গত বছর এটা বিশ্বের সব পত্রিকায় এসেছে- লেবব্রকসের কারণে। হঠাৎ করেই আমার নাম তালিকায় ওপরে উঠতে শুরু করেছে। এটা সম্পূর্ণ গোপনে হওয়াই দরকার ছিল।” কিন্তু, পুরস্কার পেলে তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন। “অবশ্যই,” তিনি বলেন। যদিও তার অবশ্যই বলাতে তেমন জোর নেই, বরং মুখ থেকে উচ্চারিত শব্দের চেয়ে তাকে অনেক দূরের মানুষ বলে মনে হয়। “কিন্তু, সত্য হচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত আমি পুরস্কার পাইনি শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। সাধারণত তারা এটা খুব বয়স্ক লেখকদেরই দেয়। এর পেছনে যথার্থ প্রজ্ঞাও আছে, এটা আপনি এমন সময় অর্জন করবেন যখন এই পুরস্কার আর আপনার লেখালেখির ওপর প্রভাব ফেলবে না।
ছবি তোলার জন্য আমরা কাছাকাছি একটা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আমাদের চারপাশে বাতাসের ঘুর্ণন, আকাশে জামাপাথরের মতো রঙ। বাতাসে ঝিমঝিম শব্দ। চিত্রগ্রাহক চাইলেন ফস্সে যেন একটা টেবিলে ওঠে দাঁড়ান, যাতে পেছনের শহরটার স্পষ্ট অবয়ব পাওয়া যায়। নিচে পড়ে যেতে পারেন ভেবে তিনি একটু আতঙ্কের ভঙ্গিতে তাকান। তাকে ছাদের কিনারে দ্বিধান্বিত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমি ছাউনির নিচে ফিরে আসি।
Discussion about this post