ফরহাদ মজহারের এই লেখাটি মন দিয়ে পড়ুন। গতকাল তিনি এই লেখাটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ফরহাদ ভাইয়ের অবস্থান জানার জন্য খুব জরুরি লেখা।
…..
“একটা প্রশ্ন করি আপনাকে। পানিতে কুমিরের মুখে পড়েছেন, আপনাকে বাঁচতে হবে। আপনি পানির দেশ, এই লড়াইটা জানেন, আর এটাও কমবেশী পরিষ্কার যে মোটামুটি জনগনের জিতবার অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারন জনগণ তাদের দুষমন চিনে ফেলেছে। এখন দরকার গণআন্দোলন গণসংগ্রাম তীব্র করা, যেন ফ্যাসস্ট শক্তিকে উৎখাত এবং পুরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা নতুন করে গঠন করা যায়।
কিন্তু আপনি তা করলেন না, ক্ষমতায় সহজে ও সংক্ষেপে যাওয়ার জন্য ডাঙ্গার বাঘ নিয়ে এলেন। এর ফল হবে বাংলাদেশ বাঘে কুমিরের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে।
দেখুন, আমরা এমন ঐতিহাসিক কালপর্বে বাস করছি যখন ভূ-রাজনীতি বাদ দিয়ে কোন জাতীয় রাজনীতি নাই। বলতে পারেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। পাশ্চাত্য প্রপাগান্ডা বাদ দিন — খবর হোল ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন ও ন্যাটো মার খেয়েছে। তবে যুদ্ধ এখনও প্রক্সি ওয়ার।
বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণকে জটিল বিশ্বব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেবার মেধা, প্রজ্ঞা ও পরিকল্পনা কি আমাদের আছে? আমরা তো আমামদের মফস্বলী কূপমণ্ডুকতা থেকে বের হতে পারছি না। বিশ্বে কি ঘটছে তার খবর আমরা রাখি না। আমাদের পত্রপত্রিকাতেও থাকে না।
তাহলে আসুন আমরা ভূরাজনীতি থেকে শিখবার জন্য পশ্চিম আফ্রিকার দিকে তাকাই। সম্প্রতি নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থান এবং তাকে ঘিরে পুরা পশ্চিম আফ্রিকায় যেভাবে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল, আসুন সেটা বোঝার চেষ্টা করি। ভাবুন, বাংলাদেশের পরিস্থিতির সমাধান রাজনৈতিক ভাবে – বিশেষত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হবে সেটা কি আসলেই আদৌ আশা করা যায়? যদি না যায় তাহলে সঠিক কৌশল নিয়ে ভাবুন। জনগণকে ভাবতে দিন।
এখন একটি মানচিত্র দেখাচ্ছি পশ্চিম আফ্রিকায় রুশ প্রভাব বোঝাবার জন্য। রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক চুক্তি হয়েছে আফ্রিকার কয়টি দেশে সেটা দেখুন। পরে লিখছি আরও, আমাদের জন্য নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানের মানে কী?
জ্বি, বুঝেছি আপনি অবশ্যই চিন আর রাশিয়ায়া গণতন্ত্র নাই বলবেন। আরও বহু কিছু বলবেন। বলুন। সত্য এই যে আফিকার জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ঔপবেশিক ইউরোপীয় দেশগুলোর পাশ্চাতভাগে লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দেবার রণধ্বনি তুলেছে। রাশিয়ার পতাকা ওড়াচ্ছে। এর অর্থ বোঝার দরকার আছে।
কিন্তু আপনি? আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সহযোগী ইউরোপকে ডেকে আনছেন। নাকি? মার্কিন স্যাংশনে গদ গদ হয়ে গিয়েছেন কুমিরের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আপনি বাঘকে মামা ডেকে ডাঙায় বাঘের মুখে পড়তে চাইছেন।
পুরা আফ্রিকা মহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ফ্রান্স এবং ন্যাটোভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। তারা চায়না মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তি তাদের দেশ শোষণ লুন্ঠন করে আরও ছ্যাবড়া বানিয়ে ফেলুক। তারা যে বাঘ তাড়াচ্ছে, আমরা সহজে ক্ষমতায় যাবার জন্য তাদেরকেই ডেকে আনছি আমাদের অন্দর মহলে। পুরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ফ্রান্স এবং ন্যাটোভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাড়াবার জন্য জনগণ কেন ক্ষিপ্ত সেটা আমাদের বোঝা দরকার।
কিন্তু আমরা ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গদ গদ। কেন?”
…..
ফরহাদ ভাই ফেসবুকে লেখাটি পোস্ট করে সঙ্গে একটি ছবি জুড়ে দিয়েছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশ ইতিমধ্যে লাল চিহ্নিত হয়ে গেছে।
ফরহাদ ভাই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। সেটা হলো, পানির কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমরা কেন মাটিতে বাঘ ডেকে আনছি? শেষে প্রশ্নটা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এত গদগদ কেন?
ফরহাদ ভাইয়ের পোস্টের নিচে আমি একটি কমেন্ট করেছিলাম। সেই কমেন্টটি সম্ভবত তিনি ডিলেট করে দিয়েছেন।
পশ্চিমা রূপকথা থেকে ধার করে কমেন্টটা করেছিলাম। এটা মূলত একটা রহস্যময় বাক্য। বাক্যটি হলো, কেননা আমরা চিনি চিন চিন।
ফরহাদ ভাই কৌশলে বলতে চাইছেন, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যখন মার্কিন ও ইউরোপীয় বলয় থেকে বের হয়ে রাশিয়া ও চীন বলয়ে ঢুকে যাচ্ছে তখন আমরা কেন মার্কিন ও ইউরোপীয়দের আমাদের সমস্যার সমাধানের জন্য ডেকে আনছি?
আমরা সকলেই জানি, চিন্তার বিনিয়োগ ও ব্যবসার কূটনীতি দিয়ে শুধু আফ্রিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্য এশিয়া এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোতেও নিজের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর তারা মিত্র হিসেবে রাশিয়াকে পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসক, রাজতান্ত্রিক শাসকদের উৎসাহিত করে চলেছে। আফ্রিকায় একের পর এক দেশে গণতন্ত্রের শেষ সম্ভাবনাটুকু ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এবং অনেক জায়গায় তারা সফলও হয়েছে।
এ কথা সত্যি, আফ্রিকা জুড়ে ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের শাসন শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তারমানে আফ্রিকানদের কাছে আমেরিকা ও ইউরোপ পানির কুমির হতে পারে। কিন্তু পানির কুমির ঠেকাতে তারা মাটিতে চীন ও রাশিয়াকে কি ডেকে আনছে না? আর এই ডাকাডাকির মধ্য দিয়ে তারা তাদের দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের শেষ আশাগুলোকেও কি ধ্বংস করে দিচ্ছে না? আর সেই সব দেশে চীন রাশিয়া বলয়ের অগণতান্ত্রিক শাসন টেনে আনার পেছনে জনগণের কতটা ভূমিকা আর সুবিধাভোগী উচ্চ শ্রেণী ও শাসক শ্রেণীর কতটা ভূমিকা সেটা কে আমাদের জানাবে?
আফ্রিকার অনেক দেশের স্বৈরশাসকরা পশ্চিমা বলয়ের বাইরে গিয়ে চীন ও রাশিয়া বলয়ে ঢুকে যাচ্ছে বলে আমাদের চীন ও রাশিয়া বলয়েই ঢুকতে হবে এর পেছনে যুক্তি কী?
প্রকৃত সত্য হলো, আমাদের শাসকরা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তাদের অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃতবাদী শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য ইতিমধ্যে ইউরোপ আমেরিকার বলয় থেকে বেরিয়ে চীন ও রুশ বলয়ের মধ্যে ঢুকে গেছেন। এবং আফ্রিকার দেশগুলোর মতো এখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। যে বলয়ের মধ্যে জনগণের ইচ্ছার বাইরে আমরা ঢুকে গেছি সেই বলয়ে আফ্রিকা এখন ঢুকছে বলে আমাদের নতুন করে আবার ঢুকতে হবে কেন?
ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকা আপাত অর্থে জিততে পারেনি বলে?
নাকি ফরহাদ ভাইয়ের প্রস্তাব হলো, গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা ইউরোপ-আমেরিকা, রুশ-চীন বলয়ের বাইরে গিয়ে একটা স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করবো?
আমার মনে হয়, ফরহাদ ভাইয়ের মত একজন জ্ঞানী ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে ওয়াকিবহাল ব্যক্তি এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারেন না। কারণ এরকম একটি অবস্থান নিতে হলে আমাদেরকে হয় ভারত হতে হবে, নয়তো ভারতের সঙ্গে জুড়ে যেতে হবে।
তাহলে ফরহাদ ভাই মার্কিন-বিদ্বেষী অবস্থান গ্রহণ করছেন কেন? তারা বাংলাদেশকে চীন-রাশিয়া বলয় থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায় বলে?
এবং এটা করতে গেলে বাংলাদেশে চীন-রাশিয়া-ভারত বলয়ের সরকারের পতন ঘটবে বলে?
আজকে ফরহাদ ভাই আন্দোলনে জনগণের বিপুল উপস্থিতি দেখে উল্লসিত হচ্ছেন, মনে করছেন এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু আসলেই কি তিনি মনে করছেন? কেননা আমরাও জানি, তিনিও জানেন প্রকরণের দিক থেকে এই গণ-আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের বীজ বহন করে না। ভারত চীন ও রাশিয়া সমর্থিত প্রবল প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ সরকার গত এক দশকে বিরোধীদের কোনোভাবে মাঠে নামতে দেয়নি। শুধু তাই নয়, একতরফা নির্বাচন করে বিনা ভোটে রাতের ভোটে তারা ক্ষমতা চালিয়ে যাওয়ার পরও বিরোধীরা তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সম্প্রতি যে আন্দোলন তৈরি হয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই হতে পেরেছে। এখানে ফরহাদ ভাই কোথায় গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখতে পান আমি জানিনা। তিনি কি তাহলে আমাদের বিভ্রান্ত করছেন?
তিনি কি আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পাকাপাকিভাবে রুশ ও চীন বলয়কে সমর্থন দিয়েছেন?
প্রকারান্তরে অসম্ভব গণঅভ্যুত্থানের চিন্তা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অসারতার কথাই কি তিনি বারবার বলছেন না?
ফরহাদ ভাই পানিতে কুমির ও মাটিতে বাঘের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের অবস্থা বোধহয় অতটা সরল না। আমাদের পানিতে কুমির বটে, তার সঙ্গে বাঘ ও আছে। অর্থাৎ রাশিয়া চীনের সঙ্গে পানিতে ভারতও আছে। এই ভারতকে পানিতে নামিয়ে ছিল আমেরিকাই। এখন আমেরিকা যদি মাটিতে আসেও তবে তাকে নিজের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের যাওয়া ঐতিহাসিক কারণে আজ এক বিন্দুতে মিলেছে। আমাদের প্রথম কাজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এরপর অন্য কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যদি পরে মোকাবেলা করতে হয় তখন না হয় ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমরা জোট করে আবার গণঅভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে যাব।
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে বলে বিস্তারিত আর কিছু বললাম না।
আপাতত ফরহাদ ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে একটা কথাই বলার, সেটা হল- কেননা আমরা চিনি চিন চিন।
Discussion about this post