কখনো নিজেকে কোনো কল্পিত অথবা ফিকশনাল গল্পের খলনায়ক হিসেবে চিন্তা করে দেখেছেন? উদাহরণ হিসেবে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হতে পারে ডিসি কমিকসের জোকার চরিত্র। জোকার ও ব্যাটম্যান চরিত্র দুইটি বেশি প্রশংসা পায় ফিল্মমেকার ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যাটম্যান ফ্রাঞ্চাইজির কারণে। ডিসি ইউনিভার্সে অন্যতম জনপ্রিয় সুপারহিরো ব্যাটম্যানকে ছাড়িয়ে সুপারভিলেন জোকার আরও বেশি প্রশংসিত হতে থাকে। এটি কয়েক ধাপ বেড়ে যায় টোড ফিলিপসের জোকার ফ্রাইঞ্চাইজির মধ্য দিয়ে। এমনকি এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য হেদ লেজার ও হোয়াকুইন ফিনিক্স উভয়ই অস্কার জিতে নেন। অথচ এই সুপারভিলেন চরিত্রটি গোথাম শহরের এক কুখ্যাত সাইকো-কিলার।
তাহলে মানুষ কেন এই ভিলেন চরিত্রগুলোর প্রতি এত আকর্ষণ অনুভব করে? শুধুই কি অভিনেতার অভিনয়শৈলীর জন্য? কেবল সাইকোলজিক্যাল নর্মসের জন্য? নাকি অন্য কিছু আছে এর পেছনে?
চলুন জেনে আসা যাক, এর পিছনের অন্য এক বিশ্লেষণ।
গেমারদের মধ্যে খুব কম মানুষই আছেন যারা ‘গ্র্যান্ড থেফট অটো’ ফ্রাঞ্চাইজির নাম শোনেন নি অথবা খেলেন নি।
জিটিএ গেমের যাত্রা শুরু হয় চারবন্ধুর হাত ধরে। তাদের মধ্যে ডেভিড জোনাসের ইচ্ছা ছিল ভার্চুয়াল থ্রিডি গেম নির্মাণের। তখন সানফ্রানসিস্কোতে গ্যাংস্টারদের দৌরাত্ম্য ছিল সবখানে। একদিন তিনি দেখেন, এক চোর দোকান থেকে টাকা চুরি করে পালাচ্ছে। পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও চোরটিকে ধরতে পারলো না। তখনই গেমের মূল পরিকল্পনা পরিবর্তন করে বসে তারা। তারা প্রথমে প্রধান চরিত্র হিসেবে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সারা দুনিয়ায় পরিচিত করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনা দেখার পর তারা বুঝতে পারে গেমাররা ভিলেন হয়ে খেলতেই বেশি মজা পাবে। তাদের উপলব্ধি হলো, পুলিশ হয়ে ভিলেনের পেছনে না ঘুরে ভিলেন হয়ে পুলিশকে পেছনে পেছনে ঘোরানো বেশি মজার হবে। এবং এখান থেকে জিটিএ যাত্রা শুরু করে। গেমটি সে সময় বেশ আলোড়নের জন্ম দেয় সর্বপ্রথম এন্টাগনিস্টকে প্রোটাগনিস্ট হিসেবে দেখানোর কারণে। জিটিএ-এর প্রত্যেকটা ভার্সনেই দেখা যায়, ক্লাউড থেকে শুরু করে টমি ভারসিটি, কার্ল জনসন এবং ট্রেভর ফিলিপস- ফ্রাঙ্কলিন ক্লিনটন প্রত্যেকেই একেকজন ভিলেন চরিত্র।
এবার জোকার চরিত্রে নজর দেয়া যাক। জোকারকে মুভির পর্দায় নিয়ে আসা হয় ২০১৯ সালে।
ব্যক্তির নাম আরথার ফ্লেক, পেশায় যিনি স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান। তিনি জীবনে একা একজন মানুষ। আরথার এক সময় কঠিন বাস্তবতার কাছে হার মানতে বাধ্য হয় এবং হয়ে ওঠে এক সাইকপ্যাথ। সে শহরবাসীর সামনে হাজির হয় প্রচলিত সমাজের বিপরীতে এক নতুন সম্ভাবনা হয়ে, সাব-অল্টার্নদের মাঝে।
বাস্তব সমাজের বিচারে চরিত্রটি দুর্ধর্ষ হওয়া সত্ত্বেও এই চরিত্র দিনকে দিন জনপ্রিয়তা পেতে থাকে এবং আরও প্রিয়তর সুপারভিলেনে পরিণত হয় । কিন্তু বাস্তব সমাজের একজন সুস্থ মানুষের কি এমন চরিত্রে সমর্থনে থাকার কথা?
ক্রিশ্চিয়ান বেলের ২০০০ সালের বিখ্যাত মুভি ‘আমেরিকান সাইকো’। মুভির প্লট পেট্রিক বেইটম্যান নামের একজন খুনি সাইকোপ্যাথ, যে চরিত্রের জনপ্রিয়তাও শুধু তার নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের জন্য।
মানুষ যা চায় তাই করতে সর্বোচ্চ চেষ্টার স্পৃহাকে প্রতিনিধিত্ব করে ইএনটিজে ( Extraverted, Intuitive, Thinking, and Judging) পারসোনালিটি। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক আছে। কিন্তু বেইটম্যান নেতিবাচক ইএনটিজে এক চরিত্র।
সাইকোলজিতে একটা টার্ম আছে। তা হলো এসএডি (Seasonal affective disorder)। কেউ যখন একাধিকবার অন্যের দ্বারা নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার আশংকায় থাকে, তখন বলা হয় তিনি এসএডিতে আক্রান্ত।
গবেষকরা অনুসন্ধান করেছেন, জাজমেন্টের আশঙ্কা থেকে রেহাই পেতে মানুষে ভেতরের নেতিবাচক চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নিরাপদ উপায় হিসাবে ভিলেনের পক্ষপাতি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, হ্যারি পটার দ্রুত ডার্ক লর্ডের সাথে তার ব্যক্তিত্বের সাদৃশ্য অস্বীকার করেছিল, যখন ভলডেমর্ট বলেছিল যে সে এবং হ্যারি অনেকটা একই রকম। এজন্যই মানুষ সাধারণত এমন কোনও তথ্য এড়াতে চেষ্টা করে যা তাদের নিজেদের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে।
মানুষের সাইকোলজি এক্ষেত্রে কোন ম্যাকানিজমে কাজ করে তা নিয়ে গবেষণা করেন রেবেকা জে. ক্রাউস এবং ডেরেক ডি. রাকার । তাদের গবেষণাপত্রটি ‘ক্যান ব্যাড বি গুড? দ্য অ্যাট্রাকশন অব আ ডার্কসেলফ’ নামে প্রকাশিত হয়। তাদের ভাষ্যে, কিছু সময় ধরে যখন মানুষ এসব ভিলেন চরিত্রের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে- সেটাই হল তাদের ব্যক্তিত্বের অন্ধকার জগৎ।
গবেষণা সিরিজের একটি সমীক্ষায় তারা পরীক্ষা করেছেন, ব্যক্তিত্বের একটা পর্যায়ে মানুষের নেতিবাচক অন্য কোনো চরিত্রের সাথে মিলতে চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিনা এবং থাকলেও তা কতটুকু।
সেজন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন তারা। ব্যবহারকারীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু ভিলেন ও নন-ভিলেন চরিত্র নেয়া হয়। তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, তাদের ব্যক্তিত্বের সাথে যায় এমন চরিত্রই তাদেরকে বেশি আকৃষ্ট করে তা ভিলেন চরিত্র হলেও।
ভিন্ন একটি স্ট্যাডি থেকে জানা যায় যে, বাস্তব জীবনের ভিলেনের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার কম প্রবণতা দেখা যায়। যেখানে ফিকশনাল নেতিবাচকতায় অংশ নেওয়ার মাত্রা অনেক বেশি।
এটাও জানা যায়, বাস্তবজীবনের ভিলেনরা ফিকশনের ভিলেন চরিত্রগুলোর চেয়ে কম স্বস্তিকর তাদের কাছে। অর্থাৎ ভিলেন হিসেবে সে পর্দাতেই নিজেকে বিবেচনা করতে পারে, বাস্তবে নয়।
ক্রাউস এবং রুকাড়ের মতে, মানুষ সবসময় একই ধরনের নেতিবাচক মানুষদের দ্বারা প্রভাবিত হয় না; পরনির্ভরশীলতার উদ্বেগ প্রশমিত হলেই কেবল তারা অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে এবং এক্ষেত্রে তারা ভিলেন কি ননভিলেন তাতে তেমন কিছু যায় আসে না।
Discussion about this post