শিক্ষকদের অবহেলা আর বৈষম্যের চিত্রটা অনেক পুরনো। আমাদের সাহিত্য শিক্ষকের ললাটে অংকন করেছে ‘সামান্য’ নামক বিশেষণ। শিক্ষকের কালজয়ী চরিত্র ‘পণ্ডিতমশাই’ আর ‘তালেব মাস্টার’। শিক্ষকদের জীবনমান বিশ্লেষণে এ দুই চরিত্র আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। সহজ পথে জীবনমান অতিক্রম করতে পারেনি তালেব মাস্টারের দুঃসহ জীবন।
কিন্তু শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক স্তর। শিক্ষার উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনা সফল করতে হলে প্রথমে দৃষ্টি দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার দিকে। আর এই ব্যবস্থার মূল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
সদ্য স্বাধীন দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের মেধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে নজর দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু একটু একটু করে এগিয়ে, ধাপে ধাপে উন্নয়নের সিঁড়ি অতিক্রম করে দেশে শুধু এসএসসি পাসে সীমাবদ্ধ থাকেনি প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ অতিক্রম করা ব্যক্তিরা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, উন্নত দেশের শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণসহ নানা দিক দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা আজ অনেক পরিণত ও দক্ষ।
কিন্তু মেরুদণ্ড সোজা করে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য, উন্নত জীবনমান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য যে নির্ভীক শিক্ষক প্রয়োজন তা অনুপস্থিত। সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কমর্চারী। তৃতীয় শ্রেণির গুরু দিয়ে প্রথম শ্রেণির আত্মমযার্দা বোধসম্পন্ন জাতি গঠনের স্বপ্ন আমরা কীভাবে দেখবো? প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সরকারি ড্রাইভারের স্কেলের বেতনের চেয়ে এক ধাপ নিচে। অন্যান্য সরকারি কমর্চারিদের চেয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধাও কম।
শিক্ষকদের শত শত বছরের বৈষম্যের, দারিদ্র্যের, অবহেলার যে চিত্র তা বদলের জন্য যে আন্দোলন, তা এতগুলো বছরে আন্দোলনই হয়ে উঠতে পারেনি। ‘শিক্ষক’ শব্দটি দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা, সত্য প্রকাশে নিরঙ্কুশ সাহস, মাথা উঁচু করে সম্মান ও মযার্দার সঙ্গে বাঁচা বোঝায়। শিক্ষক নামক শব্দটির সঙ্গে তোষামোদ, দালালি এই শব্দ দুটি সাংঘর্ষিক। কিন্তু যুগে যুগে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে, গুরু নামক শব্দটির তাৎপর্য সমাজের কাছে তুলে ধরতে, দরিদ্র্যতার করাল গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে শিক্ষক সমাজ যখনই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের সম্মান ও মযার্দার কথা তুলে ধরতে চেয়েছে তখনই এই শিক্ষকদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছে একদল প্রতারক, বেঈমান।
পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি আর দ্বন্দ্বের কারণে কখনো শিক্ষকের শিক্ষক হয়ে ওঠা হয়নি। সংখ্যায় যারা সরকারি কমর্চারী হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের নেতৃত্ব থাকবে একটা সংগঠনের হাতে। অথচ অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের জালে আটকে পড়া শিক্ষকরা একাধিক নেতৃত্বের কারণে বিভক্ত।
দীর্ঘ বঞ্চনার অবসান চেয়ে যতবার শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলন সফলতার কাছাকাছি গিয়েছে ততবারই চতুরতার পরিচয় দিয়েছে প্রশাসন।
কোনো না কোনোভাবে শিক্ষকদের একতা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। তাদের লোভ আর মোহের জালে ফাঁসানো হয়েছে।
এবার প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেডের দাবি যখন বেগবান তখনই টোপ হিসাবে তৈরি হচ্ছে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষকের’ পদ।
সহকারী এবং প্রধান শিক্ষকরা একসঙ্গে শুরু করেছিল একটি যৌক্তিক আন্দোলন। প্রধান শিক্ষকদের দাবি মেনে নিয়ে সহকারী শিক্ষকদের দমন করার এক সূক্ষ্ম চাল চালা হয় এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। সততার পরিচয় দিয়ে প্রধান শিক্ষকরা এই প্রাপ্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। একই উদ্দেশ্য নিয়ে সহকারী ও প্রধানদের যে পথচলা তা একই সঙ্গে বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই সততা দেখাতে প্রধান শিক্ষকরা ব্যর্থ হলেন।
ফলে, আন্দোলন ব্যর্থ হলো।
যে পদোন্নতি আটকে আছে যুগের পর যুগ, সে পদোন্নতি চালু হলে সহকারী শিক্ষকের পরের পদ প্রধান শিক্ষক। কিন্তু এই নতুন পদ চালু হলে ‘সহকারী’র পরের পদ হবে ‘সহকারী প্রধান’, তারপর ‘প্রধান’। ফলে আরও উচ্চ পদে যাওয়া একজন্মে আর সম্ভব হবে না। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্যসব ক্ষেত্রে পদোন্নতি পেয়ে বন্ধুরা চলে যায় শীর্ষে। গাড়ি, বাড়ি, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবন কাটায়, ঠিক তখন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শেষ জীবনে মেয়ের বিয়ে, নিজের চিকিৎসা খরচের জন্য হাত পাতে দ্বারে দ্বারে। একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর কাছে এ দেশ, এ জাতি কেন আশা করবে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে চির অসম্মান আর দারিদ্র্যকে ধারণ করবেন?
এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষক তার মযার্দা রক্ষার আন্দোলনে যখন পুলিশের পিপার স্প্রের কারণে মৃত্যুবরণ করে তখন সেটা আন্দোলনে মৃত্যু হয় না। সেটা হয় দুবর্ল শরীরের অপুষ্টিজনিত মৃত্যু। বিভক্ত করো, শাসন করো শিখিয়ে ছিল ব্রিটিশরা। অসংখ্য শিক্ষক সংগঠন, সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, শিক্ষকদের চাটুকারী মনোভাব এতোগুলো বছরেও পরিবতর্ন আনতে পারেনি। নানা ধরনের বৈষম্য অর্থোপার্জনের বাঁকা পথ সৃষ্টি করেছে, শিক্ষকদের ঠেলে দিয়েছে অসততার পথে।
কয়েক বছর আগে তীব্র শীত উপেক্ষা করে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে ছুটে এসেছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল কমের্ক্ষত্রে। তারপর থেকেই শুরু হলো ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’- পদের নামে চতুরতা। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব- প্রত্যেকেই তাদের উচ্চশিক্ষার ধাপ অতিক্রম করার শুরুটা করেছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে। শত শত বছরের বঞ্চনা ফুলেফেঁপে আজ যে বিশাল আকার ধারণ করেছে তা সমাজের কাছে তুলে ধরে এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য, শৈশবের শিক্ষাগুরুর মযার্দা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো দায়বদ্ধতাই কি নেই কারও?
শিক্ষকের উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে আনন্দের সঙ্গে, তৃপ্তির সঙ্গে পাঠদানের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
পদোন্নতির শুভঙ্করের ফাঁকিতে সহকারী শিক্ষকদের না ফেলে শিক্ষকদের দশম গ্রেড প্রদান করে শিক্ষা এবং শিক্ষক উভয়কেই স্মার্ট করা হোক। একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, এটা জাতির জন্য অপমান এবং লজ্জার। আশাকরি, নীতি-নির্ধারকদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০টির উপরে নানা ধরনের রেজিস্টার। তার ওপর আছে উপবৃত্তির কাজ। শিশু জরিপ, নিবার্চন, হোম ভিজিট, নানা দিবস পালনসহ হাজারটা কাজে লেখাপড়া ছাড়া অন্যসব কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করতে শিক্ষকদের বাধ্য করা হয়।
এইসব কাজ করতে গিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। শিক্ষা-বহির্ভূত বাড়তি কাজের জন্য লোক প্রয়োজন। ফলে, নানা ধরনের কাজের জন্য ‘অফিস সহকারী’ নিয়োগও এখন সময়ের দাবি।
Discussion about this post