‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় টকশো। জনগণের মাঝে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ খোরাক জোগায় এই টকশো। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের মুখোমুখি হয়েছিলেন খালেদ মুহিউদ্দীন। সেই সব আলোচনায় মানুষ কতটা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, বিরোধী দল বিহীন ডামি নির্বাচন অভ্যন্তরীণভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, এই নির্বাচন করাটা আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিকভাবে জয় না পরাজয়- এসব বিষয় উঠে এসেছে।
১২ জানুয়ারি, ২০২৪-এ খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায় অনুষ্ঠানে ‘কে সরকারি কে বিরোধী?’ শীর্ষক আলোচনায় অতিথি ছিলেন গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নব-নির্বাচিত এমপি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ইতিমধ্যেই টকশোটি দেখেছেন প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ। আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হলো এমন একসময়, যার মাত্র ৫ দিন আগে একটা ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি ও ৩০ ডিসেম্বরের মতো দুটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ভীষণভাবে ভুলণ্ঠিত হয়েছে এ নির্বাচন-পরবর্তী শাসনামলে। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটের আগেই ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে সে নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দলীয় সরকারের অধীনে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। রাতের বেলা ভোট হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে যে সুষ্ঠু নির্বাচন বা জনগণের ভোটাধিকার নিরাপদ নয় তা এই দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশের জনগণের কাছেই নয় বরং পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। তাই বিরোধী দলগুলো জনগণের ভোটাধিকার ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দাবিকে সামনে রেখে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ ধারায় আন্দোলন করেছে। জনগণের ভোটাধিকার ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে ৩১ দফা প্রণয়ণের মাধ্যমে ২০২৩ সালের ১২ জুলাই থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। পরে সারাদেশে, বিশেষত ঢাকায় যুগপৎ আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পালিত হয়। সেসব কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। তার কাউন্টার হিসেবে শান্তি সমাবেশের নামে মাঠে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। তাই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও।
গত ২৮ আক্টোবরের যুগপৎ আন্দোলনের মহাসমাবেশ, গণসমাবেশের কর্মসূচি ছিল। বিএনপির সেই মহাসমাবেশ কর্মসূচি ভণ্ডুল করে কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় ২০ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৭ অক্টোবর বেসরকারী এক টেলিভিশন চ্যানেলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, “বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে জেলে না রাখলে দেশ অচল হয়ে যেত। বিএনপির ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে হরতালের দিন গাড়ি চলতো না। এছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। যেটা করেছি, চিন্তাভাবনা করেই বলেছি। তাদের জেলে না রাখলে দেশ অচল হয়ে যেতো।”
সরকার যে অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার করেছে তা ড. আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে জনগণের কাছে। কার্যত এই ক্রাকডাউনের পর বিএনপির বেশিরভাগ নেতা-কর্মী আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। এই সময়ে আন্দোলনে মাঠে থেকেছেন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতৃবৃন্দ। সেই নেতৃবৃন্দের মধ্যে জোনায়েদ সাকি সম্ভবত অন্য অনেকের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে মানুষের কাছে বেশি পৌঁছেছেন এবং বিরোধীদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বিরোধীরা তাদের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে পারেননি, বিরোধী রাজনৈতিক দল ছাড়াই সরকার একতরফাভাবে নির্বাচন করেছে। সরকারী দল আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের পাশাপাশি দলের অন্য সদস্যদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দলীয়ভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পুরো সময়টাতেই গণসংযোগ কর্মসূচি করেছে। বিরোধীদের সমর্থনে সাড়া দিয়ে জনগণ যেভাবে নির্বাচন বয়কট করেছে তাকে এককথায় অভূতপূর্ব সাড়া বলেই মনে করছে বিরোধীরা যা তাদের নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক সংগ্রামে ফুয়েল জোগাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে, ভোটে অংশগ্রহণ করেছে ৪১ শতাংশ ভোটার। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা মনে করছেন নির্বাচনে শতকরা ১০ শতাংশ ভোটারও অংশগ্রহণ করে নি। প্রকৃত হার ৭%-এর বেশি হবে না।
এরকম একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে জনগণের মুখোমুখি করা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের আছে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে এমন ন্যক্কারজনক ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরপর তিনটার্ম ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে আওয়ামী লীগকে জনগণের মুখোমুখি করার কাজটা করার মতো মিডিয়া বা সংবাদপত্র আর করতে পারছে না। প্রশ্ন করার এই সক্ষমতা হারিয়ে দেশের মূলধারার টেলিভিশন টকশো প্রায় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ অনুষ্ঠানে অতিথিদের অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন করা হয় বলেই এই টকশো নিয়ে মানুষের আগ্রহ রয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে খালেদ মুহিউদ্দীন বিভিন্ন সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের এই ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগকে জনগণের মুখোমুখি করার সুযোগ তাঁর ছিল। সেখানে বিরোধীদলের যুগপৎ আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা জোনায়েদ সাকীর বিপরীতে তিনি অতিথি হিসেবে উপস্থিত করলেন সোশাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে। যিনি আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কেউ তো ননই বরং খালেদ মুহিউদ্দীনের ভাষায় গ্র্যান্ড ডিজাইনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া একজন ব্যক্তি। তিনি সংসদে বিরোধী ভূমিকা রাখতে চান। এবং বিরোধী ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণ যে নির্বাচন বর্জন করেছে তার কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য তার কাছে নাই। এরকম একটা সময়ে খালেদ মুহিউদ্দীন বরং আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কাউকে প্রশ্নের মুখোমুখি করলে সামনের দিনের রাজনৈতিক গতিপথ বুঝতে তা জনগণকে সাহায্য করতো।
Discussion about this post