গত শনিবার ইসরায়েলে বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এরপর রবিবার দিনভর গাজা উপত্যকায় পাল্টা বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় এখন পর্যন্ত ৩১৩ জনের বেশি ফিলিস্তিনি এবং অন্তত ৬০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে এবং বন্দি করা হয়েছে ১০০ ইসরায়েলিকে।
বহু বছর ধরেই অমীমাংসিত সংঘাতে জড়িয়ে আছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ফিলিস্তিনি নিহতের খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা করে নেয়। কিন্তু এই সংঘাতের শুরু আরো আগে থেকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদীরা ব্যাপক বিদ্বেষ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সে সময় ফিলিস্তিন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। এটি মুসলিম, ইহুদী এবং খ্রিষ্টান- এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি ও ব্রিটিশদের মিত্র আরব জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহীদের হাতে অটোমান সম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। তখন যে লিগ অব নেশন গঠিত হয়েছিল, সেই বিশ্বসংস্থার পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট’ দেয়া হয় ফিলিস্তিন শাসন করার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইহুদীকে হত্যা করার পর ইহুদীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ বাড়তে থাকে। এই পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোর ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে একটি চিঠি লেখেন যা বেলফোর ঘোষণ হিসেবে পরিচিত। এই চিঠি ইহুদিদের দাবিকে গতি দেয়। শেষ পর্যন্ত এই ঘোষণার ৩১ বছরের মাথায় পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমিতে জোরপূর্বক ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করা হয়। ইসরায়েলিরা বেলফোর ঘোষণাকে তাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখে। বেলফোর ঘোষণাকে ইসরায়েল গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিন ও আরবদের কাছে এটি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত। মাত্র ৬৭ শব্দের চিঠিটি একটি জাতির স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল। চিঠিটি খুব ছোট হলেও এটি ইতিহাসের এক দীর্ঘকালীন মানবিক সংকটের প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল। এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের ওই অঞ্চলের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে বেলফোর ঘোষণাই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল জাতিগত সংঘাতের দ্বার উন্মোচন করে দেয়।
এর পর থেকে শুরু হয় দীর্ঘ সংঘাতের পর্ব ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এত বছরেও হানাহানিতে বিরাম নেই। ৭৫ বছর ধরে চলছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এই সংঘাত। এর মধ্যে ৪টি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ দেখেছে পৃথিবী। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এই সংঘাতে ইসরায়েলের হামলার ফিলিস্তিনের লাখ লাখ অধিবাসীদের ওপর নেমে এসেছে অনিঃশেষ বিপর্যয়। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সেনারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হত্যা-ধর্ষণ-লুট-অগ্নিসংযোগ চলমান রেখেছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফিলিস্তিনিকে ঘর থেকে বের করে তার ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারো ভিটেমাটি, কারো বা ফসলের জমি কেড়ে নিচ্ছে ইসরায়েল। প্রাণভয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে পালাচ্ছে। তারা দলে দলে জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় গিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিচ্ছে। আর কিছু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে পাল্টা হামলা ও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে আসছে।
পশ্চিমা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে ইসরায়েলকে সমর্থন ও সাহায্য করে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতির কর্তৃত্ব ব্রিটিশদের হাত থেকে দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। এই দুই পরাশক্তি নিজেদের মধ্যে কোনোদিন সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত না হলেও তাদের সমর্থিত রাষ্ট্রগুলোকে কখনো সেনা, কখনো অস্ত্র, কখনো বা ভেটো দিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংঘাতে ইসরায়েলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য করে আসছে মার্কিনিরা। শুধু ২০২০ সালেই ইসরায়েলের সামরিক খাতে আমেরিকার সাহায্য ছিল ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমেরিকা তার ভেটো দেবার ক্ষমতা ব্যবহার করেছে মোট ৮৪ বার, যার মধ্যে ৪৩ বারই ইসরায়েলের পক্ষে, ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মে, ২০২১-এ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ বন্ধের জন্য যুদ্ধবিরতি আহবান করে একটি সামান্য বিবৃতি দিতে চাইলে সেটাতেও ভেটো দেয় আমেরিকা।
অন্যদিকে সংকট সমাধানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলাদা দুই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বাস্তবায়ন এবং ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার মূল উপায়।” যদিও এই পরিস্থিতির সহসা কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে ভবিষ্যতের যে কোনো শান্তি চুক্তির আগে দু’পক্ষকে জটিল সব সমস্যার সমাধানে একমত হতে হবে। তাছাড়া এটা স্পষ্ট, আরব ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার পূর্ণ মর্যাদা ছাড়া এই চলমান যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না, এর সাথে জাতিসংঘ ও শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থহীন ভূমিকা এই সংকটের পরিপূর্ণ সমাধান এনে দিতে পারে।
Discussion about this post