কাসাভা একটি কন্দ জাতীয় ফসল, ইংরেজি নাম মনিহট ইসোলেন্টা (Monihot Esculenta) । এটি বহুবর্ষজীবী গুল্ম শ্রেণীর গাছ। কাণ্ড গিঁট যুক্ত, আগা ছড়ানো, পাতা যৌগিক, গড়ন শিমুল পাতার মতো, করতলাকৃতি, লালচে রঙের দীর্ঘ বৃন্তের মাথায় লম্বাটে ছয় থেকে সাতটি পত্রিকা থাকে। কাসাভা গাছের শিকড়-জাত এক ধরনের আলু। জন্মে মাটির নিচে। নানা পদ্ধতিতে এ আলু খাওয়া যায়। স্থানভেদে ক্যাসাভার প্রচলিত বিভিন্ন নাম রয়েছে।
কাসাভা (Cassava) বাংলাদেশে শিমুল আলু নামে পরিচিত। কাসাভা গাছের পাতা দেখতে অনেকটা শিমুল গাছের পাতার মতো। কোথাও কোথাও এটি কাঠ আলু বা ‘ঠেংগা আলু’ নামেও পরিচিত। কাসাভা পাহাড়ি, অনাবাদী এবং অপেক্ষাকৃত কম উর্বর জমিতে চাষ হয়।
কাসাভা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম শর্করা উৎপাদনকারী ফসল এবং আফ্রিকা সহ প্রায় ৫০ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য। এ কারণে আফ্রিকায় খাদ্য হিসাবেও বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে সারা পৃথিবীর উষ্ণ ও উপ-উষ্ণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে কাসাভার চাষ হচ্ছে। কাসাভা উৎপাদনে প্রথমস্থানে রয়েছে নাইজেরিয়া, তারপরেই আইভরিকোস্ট। এবং সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাইল্যান্ড। আবার ভারতেও এর উৎপাদন ব্যাপক। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে কাসাভা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে কাসাভার আগমন ঘটেছে মূলত খ্রিস্টান মিশনারিজের মাধ্যমে ১৯৪০ সালের দিকে। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে কাসাভার চাষাবাদ হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ফিলিপাইন থেকে আগত দুটি জাতের কাসাভা চাষ হতে দেখা গেছে, যার একটি লাল; অপরটি সাদাটে। বাংলাদেশে বৃহত্তম ময়মনসিংহের গারো পাহাড়, হালুয়াঘাট, ফুলবাড়িয়া, মধুপুর, ঘাটাইল, সখিপুর, নেত্রকোনা, কুমিল্লার লালমাই,পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, মিরসরাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট জেলায় কাসাভা চাষ হয়।
তবে বর্তমানে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে আফ্রিকার এই কৃষিজ ফসল কাসাভা । রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি- তিন পার্বত্য জেলাতেই কাসাভা চাষ শুরু হচ্ছে, তবে খাগড়াছড়িতে এর ব্যাপক চাষাবাদ দেখা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে রহমান কেমিক্যালস লি. ও প্রাণ-আরএফএল এই দুটি কোম্পানি সুদমুক্ত ঋণসহ সার্বিক সহায়তাদানের মাধ্যমে বানিজ্যিক ভাবে চুক্তি ভিত্তিক কাসাভা চাষে উৎসাহ যোগাচ্ছে গরীব চাষিদের। রহমান কেমিক্যালস লি. নামের প্রতিষ্ঠানটি দেশের সমতল জেলার মতো পার্বত্য এলাকায়ও সর্ব প্রথম কাসাভার চাষাবাদ শুরু করে। পরে ২০১৬ সাল থেকে প্রাণ-আরএফএলও এ প্রজেক্ট শুরু করে। কাসাভা চাষে কোম্পানি দুটির প্রতিনিধিরা চাষীদের অর্থ বিনিয়োগসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করে থাকে।
খাগড়াছড়ির রামগড়, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, গুইমারা উপজেলার বিস্তৃীর্ণ এলাকা এবং খাগড়াছড়ি সীমানা লাগোয়া উত্তর ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড়ি টিলায় কাসাভার চাষ হচ্ছে।
উৎপাদিত কাসাভা তাদের নির্ধারিত মূল্যে চাষীদের কাছ থেকে কিনে নেয় কোম্পানি দুটি। বর্তমানে খাগড়াছড়ি তে প্রায় ৩০০০ একর পাহাড়ি জমিতে কাসাভার চাষ হয়।
চাষীরা মনে করেন, অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনাবাদি জমিতে কিংবা অপেক্ষাকৃত কম উর্বর জমিতে শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগের তুলনা করলে কাসাভা চাষ লাভজনক। কৃষকরা পাহাড়ে আনারস উৎপাদন করলে বাগানে যে পরিমাণ খরচ হয় তার থেকে লাভের পরিমাণ খুবই কম, সে ক্ষেত্রে কাসাভায় লাভের পরিমাণ বেশি। মৌসুমে এক হালি আনারসের দাম ২০/২৫ টাকা। আর কাষাভা চাষে টন প্রতি ৬০০০ টাকা পায়। বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, আগে তারা পাহাড়ে আদা, হলুদসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্য চাষ করতো । এতে খরচ হতো বেশি, বাজারে সে তুলনায় দাম পাওয়া যেত না। কাঠ আলু চাষে খরচ অনেক কম দামও ভালো।
বর্ষা মৌসুমে টিলার বনজঙ্গল সাফ করে এটি রোপণ করা হয় এবং বংশ বিস্তার সাধারণত স্ট্যাম্প কাটিং এর মাধ্যমে হয়। ৮ থেকে ৯ মাস বয়সে কাটা শুরু করতে হয়। একটি কাঠ আলু গাছ ৫ থেকে ৮ ফুট লম্বা হয়। ফলন তুলনামূলক অনেক বেশি হয় একটি গাছ থেকে ১৮ থেকে ২২ কেজি কাসাভা আলু ফলন দেয়। কৃষি বিভাগের সূত্র জানায়, প্রতি একর জমি থেকে ৬-৭ টন কাসাভা পাওয়া যায়। প্রতি একরে খরচ হয় ২৫ হাজার টাকার মতো। তবে যদি উৎপাদন সময় ১২ মাস পর্যন্ত রাখা যায় সেক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমান অনেক বেড়ে যায়। আলু মাটি থেকে ওপরে তোলার সাথে সাথেই তা পরিমাপ করে কোম্পানির প্রতিনিধিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তা না হলে আলুর পানি কমে যায় এবং সাথে সাথে ওজনও কমে যায়।
কাসাভা মূলত দুটি ফরম্যাটে প্রক্রিয়াজাত করা হয়- একটি পাউডার ফরম্যাট অন্যটি কেমিকেল ফরম্যাট। কাসাভার রস থেকে পাউডার তৈরি হয়। এই পাউডার তরল করে স্টার্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয় দেশের বস্ত্র ও ওষুধশিল্পে। বস্ত্রশিল্পে সুতা ও কাপড়ের স্থায়িত্ব বাড়াতে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ আমদানি করা হয়। সাধারণ মানুষ যেমন সুতি শাড়িতে ভাতের মাড় ব্যবহার করে, তেমনি বস্ত্র খাতে সুতা ও কাপড়ে স্টার্চ ব্যবহার করা হয়। কাসাভা থেকে যে উন্নত মানের স্টার্চ পাওয়া যায় তা দিয়ে গ্লুকোজ, বার্লি, সুজি, রুটি, নুডলস, ক্র্যাকার্স, কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, পাঁপর, চিপসসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরি করা যায়। বস্ত্র ও ওষুধ শিল্পে ব্যাপকভাবে কাসাভার স্টার্চ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কাসাভা সিদ্ধ করে ভর্তা কিংবা এর পাউডার আটা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি স্টার্চ দিয়ে এনিমেল ফিডও তৈরি করা যায়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ জানিয়েছে, দেশে বছরে সাড়ে তিন লাখ টন স্টার্চ আমদানি হয়। দেশে উৎপাদিত হয় ৬ হাজার টনের মতো। বাকিটা ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়। প্রাণ দেশে ২০১৪ সাল থেকে চুক্তিভিত্তিক কাসাভার চাষ শুরু করেছে। বছরে এখন প্রায় ৬/৭ হাজার একর জমিতে কাসাভা আবাদ হচ্ছে। ফসলটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এটি অনাবাদি জমিতে চাষের উপযোগী। যেখানে আর কিছু হয় না, সেখানে কাসাভা চাষ সম্ভব। বিশেষ করে পাহাড়ি জমি ও টিলায় এটি ভালো হয়।
হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে প্রাণের সিলভান এগ্রিকালচার লিমিটেডের অধীনে একটি কাসাভা প্রক্রিয়াজাতকরণের প্লান্ট রয়েছে। যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৬০ হাজার টন কাসাভা প্রক্রিয়াজাত করা যায় এবং রহমান কেমিক্যালসের কারখানা নারায়ণগঞ্জ অবস্থিত। প্রক্রিয়াজাত করার সময় দেখা যায়, উৎপাদন হার ৩:১ হয় অর্থাৎ ৩ টন কাসাভায় ১ টন পাউডার পাওয়া যায়।
পরিবহন খরচ এই ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে, দেখা যায়, একটি ১৭/১৮ টন ক্যাপাসিটির ট্রাক খাগড়াছড়ি থেকে হবিগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছাতে ২৫০০০/-৩০০০০/- টাকা ভাড়া লাগে। এতে খরচ অনেক বেড়ে যায় এবং কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
অনেক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, খাগড়াছড়িতে একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্ট করতে পারলে কৃষকরা অনেক লাভবান হত। কারিগরি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন ৪০ টন প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতা সম্পন্ন (পাউডার এবং স্টার্চ এর জন্য) একটি প্লান্ট স্থাপন করতে খরচ হবে ১ কোটি ২৫ লক্ষ থেকে ১.৫ কোটি টাকা। তবে একটি প্লান্টের জন্য যে পরিমাণ কাসাভা প্রয়োজন তার যোগান স্থানীয়ভাবে এই মুহূর্তে নেই। তাই কাসাভার চাষ স্থানীয়ভাবে আরো বৃদ্ধি করতে হবে, তাহলেই প্রক্রিয়াজাত প্লান্ট স্থাপন এবং উৎপাদন খরচ হ্রাস করা যাবে।
কাসাভা চাষ করা হয় অনাবাদি ও পরিত্যক্ত জমিতে তাই কাসাভা চাষে পরিবেশের জন্য তেমন কোন ক্ষতিকর দিক নেই। এর থেকে উৎপাদিত পণ্যও পরিবেশ-বান্ধব, যেমন কাসাভা আলুর চামড়া থেকে দেশে তৈরি হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব পলিথিন। তবে অনেক কৃষিবিদ মনে করেন, পাহাড়ে যে পদ্ধতিতে কাসাভার চাষ হচ্ছে তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক । কাসাভার গাছের মূলই আলু হিসাবে ব্যবহার হয়। মাটির অনেক গভীরে থাকা এ মূল তোলার জন্য টিলার মাটি কোদাল দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। এভাবে এলোপাথারি খোৎড়াখুড়ির কারণে পুরো টিলার মাটিই আলগা হয়ে পড়ে। বর্ষার সময় অল্প বৃষ্টি হলে সহজেই ধসে পড়ে টিলাগুলোর মাটি। এছাড়া ভূমির উপরিভাগে থাকা মাটির উর্বর উপাদান বা টপ সয়েলও ধসে যায়। ফলে টিলাগুলো হয়ে পড়ে অনুর্বর। এক ইঞ্চি উর্বর মাটি বা এই টপ সয়েল সৃষ্টি হতে একশ বছরের মত সময় লেগে যায়। অথচ এ মূল্যবান উপাদানই নষ্ট করা হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাসাভা চাষের কারণে।
তবে রহমান কেমিক্যাল ও প্রান আর এফ এল এর কর্মকর্তারা দাবি করেন, কাসাভা চাষে মাটি ধস বা টপ সয়েল নষ্ট হয়ে পাহাড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা সঠিক নয়। কাসাভা গাছের পাতায় পুরো টিলা ঢেকে যায়। ফলে বৃষ্টির পানি সরাসরি মাটিতে পড়ে না। তাই মাটি ধসের প্রশ্নই আসে না।
এই ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ চাষীদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যা, জমি নির্বাচন এবং কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় সেই ব্যাপারে সহায়তা করতে পারে। তাহলে ই পাহাড়ে এই গুরুত্বপূর্ণ কন্দ জাতের ফসলটি উৎপাদনে সহায়ক হবে। কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা আরও উন্নত জাতের কাসাভা কীভাবে চাষ করা যায় সে ব্যাপারে কৃষি বিভাগের সরাসরি তদারকি এবং সহায়তা চান। যাতে তারা বছরে ২ বার ফলন তুলতে পারেন।
কাসাভা চাষে নেই কোনো ঝামেলা; পাওয়া যায় অল্প পরিশ্রমে অধিক ফসল। দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় সঠিকভাবে চাষাবাদ , প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাত করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাসাভা হয়ে উঠতে পারে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। এবং বদলে দিতে পারে স্থানীয় চাষী ও অর্থনীতির চাকা।
মো. সহিদুল ইসলাম সুমন : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক
[email protected]
Discussion about this post