উপদ্রুত অঞ্চলে ঝাউগাছের (Australian pine) অংকুর, চারা, ও অল্পবয়েসি গাছগুলো ম্যানুয়ালি উপড়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (UN-FAO) সংশ্লিষ্ট পাবলিকেশনে। এবং পরিণত গাছগুলাকে আগাছানাশক দিয়ে বা কেটে সাফ করার ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে।
ধরে নিচ্ছি, না বুঝেই হয়তো অনেক দশক আগে সরকারি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট দেশে লাগানো শুরু করেছিলো এই ক্ষতিকর অস্ট্রেলিয়ান পাইন। কিন্তু এখন তো সবাই জানেন যে, উপকূলীয় অঞ্চলে এই অস্ট্রেলিয়ান পাইন (ঝাউগাছ) ভূমি-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্যের সর্বনাশ করে ফেলছে। এরপরও এই গাছের উপদ্রব দূর করতে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? উল্টো কেন এখনো এই গাছ লাগানো হচ্ছে যখন সমুদ্রে ভাঙন বাড়ছে?
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার এশিয়া ও প্যাসিফিক আঞ্চলিক অফিস কর্তৃক ২০১৩ সালে প্রকাশিত এই বিষয়ক পাবলিকেশনটিতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে আগ্রাসী-আগন্তুক (invasive alien) উদ্ভিদের তালিকা দেওয়া হয় এবং এইসব উদ্ভিদের বিস্তার ও উপদ্রব রোধে ব্যবস্থাপনা পদক্ষেপও সুপারিশ করা হয়।
২০১৩ সালে ততদিনে এটা মোটামুটি একটা কমন নলেজ যে, অস্ট্রেলিয়া ও সাউথইস্ট এশিয়ার স্থানীয় গাছ এই “অস্ট্রেলিয়ান পাইন” বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেসহ দুনিয়ার নানা দেশেই ক্ষতিকর আগ্রাসী-আগন্তুক প্রজাতি হিসেবে সাব্যস্ত ও প্রমাণিত।
তাছাড়া এখনো আপনি যদি কক্সবাজারের সাগরপারের ঝাউবাগানে টানা বছর কয়েক আসা-যাওয়া করেন, তাহলে ঝাউগাছের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি যেকোনো অনুসন্ধানী মানুষ সহজেই দেখতে ও বুঝতে পারবেন। কিন্তু FAO-এর প্রকাশনাকে অনেকে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন, তাই সেটাও উল্লেখ করছি।
এশিয়া-প্যাসিফিক ফরেস্ট্রি কমিশন এবং এশিয়া প্যাসিফিক ফরেস্ট ইনভেসিভ স্পিসিস নেটওয়ার্কের প্রস্তুতকৃত প্রকাশনাটিতে বাংলাদেশের মতো দেশে ঝাউয়ের উপদ্রব সামলানোর জন্য নানা পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। যদি উপযোগী পরিবেশ থাকে, তবে ঝাউবাগান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে। উপদ্রব বেশি হলে কেটে ফেলা বা আগাছানাশক দিয়ে নির্মূল করতে হবে। তাছাড়া অংকুর, চারা, ও অল্পবয়েসি গাছগুলো ম্যানুয়ালি উপড়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু দেশে এখনো ঝাউ-উপদ্রুত অঞ্চলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তরফে এমন কোনো ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ আমরা দেখি নাই। এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ কী?
দেশের উপকূলে ভূমিক্ষয় ও ভাঙন বৃদ্ধি এবং স্থানীয় উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণবৈচিত্র্যের বিনাশের জন্য দায়ী এই অস্ট্রেলিয়ান পাইন গাছ।
এই কক্সবাজারের ছবিগুলোতে যেমন দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র-সৈকতে ও উপকূলীয় জমিতে ভূমিক্ষয় বাড়ায় এই আগ্রাসী গাছ, এবং শিকড় খাটো হবার কারণে সবার আগে উপড়ে পড়ে যদি তুফান আসে।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার বিবরণে বলা হয় : এই গাছ কোথাও একবার গেড়ে বসলে পরে ওখানে সৈকত এলাকার মাটির আলো ও তাপ এবং মাটির রসায়নের সবকিছু মৌলিকভাবে বদলে ফেলে। এই বদলে ফেলার মাধ্যমে ঝাউগাছগুলো বেড়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় স্থানীয় জাতের গাছেদের হারিয়ে দেয়, এবং শেষ পর্যন্ত স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ নির্মূল করে ফেলে। যার মধ্য দিয়ে এই গাছেরা স্থানীয় জাতের কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণির আবাসস্থল নষ্ট করে ফেলে।
কক্সবাজারে যেমন দেখা গেছে ঝাউ-উপদ্রুত সৈকত ও ডেইলগুলোতে স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ (যেমন কেয়া, নিশিন্দা, আকন্দ, ফণিমনসা, শ্যাওড়া) ইত্যাদি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
যার ফলে ঝাউবাগানের মাটি প্রতিবেশগতভাবে বন্ধ্যা (sterile) হয়ে যায়।
ভূমিক্ষয় বাড়ে, ঝড়তুফান-জলোচ্ছ্বাসে সহজেই ভাঙনের শিকার হয় সমুদ্র-সৈকত। ভারি বাতাস আসলে সবার আগে উপড়ে পড়ে ঝাউগাছ।
অথচ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট যখন এই দেশে ঝাউগাছ এনে উপকূলে বাগান করতে শুরু করে, তখন যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছিলো যে, এই গাছের বাগান বাতাস ঠেকাবে তুফানের সময়।
এই ভুল শুধু বাংলাদেশে না, আরো অন্যান্য দেশেও করা হয়েছিল। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রেও। তবে এখন যেহেতু এই ব্যাপারগুলো সবাই জানে, তাই ওইসব দেশে এখন এই ঝাউগাছের উপদ্রব ঠেকাতে নানা ব্যবস্থাপনামূলক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে কিছুদিন আগে উপকূলীয় বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা এই ভুলের কথা স্বীকার করেছিলেন একটি অনুষ্ঠানে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে কবে?
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাষ্ট্রেও অনেক দশক আগে এইরকম বাতাস ঠেকানোর চিন্তা করে এই আগন্তুক ঝাউগাছ লাগানো শুরু হয়। এখন সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে পরে ফ্লোরিডার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঝাউয়ের উপদ্রব বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সেও অনেক বছর হলো।
সৈকত ও ডেইল এলাকা থেকে যথাসম্ভব ঝাউগাছ উপড়ে ফেলে ভূমি-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য নিরাপদে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে রাষ্ট্রটি। ভুল করলে সেই ভুল তো শোধরাতেও হয় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে।
কিন্তু বাংলাদেশের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ভুল শোধরানো তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত উপকূলের প্রতিবেশগভাগে সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে পর্যন্ত এই ক্ষতিকর আগ্রাসী ঝাউগাছ লাগিয়েই যাচ্ছে। কেন?
ছবি : মোহাম্মদ আরজু
Discussion about this post