বঙ্গোপসাগরের কোল ছোঁয়া পটুয়াখালী জেলা ৮টি উপজেলা ও ৯টি থানা নিয়ে গঠিত। সৌন্দর্যে ঘেরা এই জেলার মানুষ মাছ ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
জেলার সবচেয়ে বিছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালী। চারদিকের নদীবেষ্টিত ৬ টি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলা। পটুয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিণের এই উপজেলার মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। জেলা শহর থেকে নির্বিঘ্নে যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় অবহেলায় দিন কাটছে ৬ ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের। কৃষি, মৎস্য ও পর্যটন সম্ভাবনাময় এই উপজেলাটি সঠিক তদারকির মাধ্যমে পরিচালনা করলে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
চিকিৎসা সেবার বেহাল দশার কারণে বিনা চিকিৎসায় জীবন দিতে হচ্ছে অনেককে। উপজেলা গঠনের প্রায় একযুগ পার হয়ে গেলেও এই দ্বীপবাসীর ভাগ্যে জোটেনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য পার হতে হয় নদী। কিছু জায়গায় রাস্তা থাকলেও সেগুলোতে ব্যাপক সংস্কার দরকার। অধিকাংশ রাস্তা মাটির বলে বর্ষা মৌসুমে ভোগান্তির শেষ থাকে না। ইউনিয়নগুলোতে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও নেই পর্যাপ্ত জনবল। চিকিৎসাসহ যেকোনো প্রয়োজনে জেলা শহরে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হয় আগুনমুখা নদীর উত্তাল ঢেউ আর কাঁচা-পাঁকা রাস্তা। সবমিলিয়ে কয়েকঘণ্টা সময় লেগে যায়।
পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এবং জনসচেতনতা কম থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম সবার কাছে পৌঁছাতে সময় লাগছে। সাথে আর্থিক অনটন ও রাস্তা-ঘাটের সমস্যা তো আছেই। কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, কোমলমতি শিশুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলা গাছের ভেলায় করে ছোট খাল পার হয়ে স্কুলে যাচ্ছে। বেশিরভাগ পরিবার নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত হওয়ায় শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে তাগিদ কম। রাঙ্গাবালীর একটি ইউনিয়ন চরমোন্তাজ। এই ইউনিয়নে নদীর পারে কিছু মান্তা পরিবার থাকে। যাদের দিন-রাত, খাওয়া, ঘুম সবই নৌকায়। তাদের জন্য একটি সংস্থা ভাসমান স্কুলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ভাসমান স্কুলে কিছু শিশু লেখাপড়া করছে। যাদের জীবনে শিক্ষার আলো ছিল না, তারাও কিছুটা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে কিছু পরিবার জল ছেড়ে ডাঙ্গায় সাধারণ জীবনযাপন শুরু করেছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রের। পাশাপাশি সচেতন করতে হবে পরিবার গুলোকে।
বিদ্যুতের আলো পৌঁছেছে বছর দুয়েক হলো। ২০২১ সালে নভেম্বর মাসে এ জনপদে বিদ্যুৎ পৌঁছায়। এর আগে সন্ধ্যা নামলেই হারিকেন আর কুপির আলোই ছিল একমাত্র ভরসা। বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ফলে জীবনযাপন মান কিছুটা উন্নত হচ্ছে। কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। নতুন কিছু ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় উপার্জনের জন্য মৎস্য ও কৃষি ওপর নির্ভরতা একটু কমেছে। মাছের সিজনে মাছ শিকার করে চলতে পারলেও সিজন শেষ হয়ে গেলে মৎস্য শিকারীদের জমানো টাকায় চলতে হত। সেই পরিস্থিতি থেকে কিছুটা উন্নত হচ্ছে এলাকাবাসী।
তবে কৃষকরা পাচ্ছে না তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য। বেশিরভাগ পরিবারের জীবনযাত্রা কৃষিনির্ভর। ধান-ডাল সহ পণ্যসামগ্রী স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে তাদের বলা দামেই বিক্রি করে দিতে হয়। পটুয়াখালী জেলায় যত তরমুজ চাষ হয় তার অর্ধেক আসে রাঙ্গাবালী উপজেলা থেকে। জমির উর্বরতা বেশি থাকায় তরমুজ চাষে এই এলাকার মানুষের আগ্রহ বেশি। আশপাশের এলাকা থেকে মানুষ এসে জমি কিনে এখানে তরমুজ চাষ করে। তবে পর্যাপ্ত রাস্তা-ঘাট না থাকায় পরিবহনসহ নানা রকমের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এই বিষয়ে নজর বাড়াতে হবে কর্তৃপক্ষের।
এই উপজেলা বসবাসকারীদের বড় একটি অংশ জেলে। তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মাছ শিকার। মান্তারাও জেলে। নৌকার ওপর কিছু অংশ জুড়ে ছাউনি দিয়ে থাকে তারা। রান্না, খাওয়া, ঘুম সব নৌকাতেই হয়। এসব জেলে সাগর কিংবা নদী থেকে শিকার করা মাছ সঠিক সময়ে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন না। রাজধানীতে পাঠাতে হলে একদিনের বেশি সময় লেগে যায়। যোগাযোগ বিছিন্ন থাকায় জেলা শহরে দ্রুত সময়ে নেওয়া যায় না। বঙ্গোপসাগরের সাথে ঘেঁষে থাকা উপজেলাটির মানুষ মৎস্য চাষ ও শিকার করে অর্থনীতি চাকা সচল রাখে। এখানকার জেলেদের শিকার করা মাছ ও শুটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।
রাঙ্গাবালী উপজেলায় বিভিন্ন নদীর বুকে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট চর। চরগুলোতে রয়েছে বাহারি রকমের গাছ। এ চরগুলো দেখার দায়িত্ব স্থানীয় বনবিভাগের। এ বনগুলোতে গেলে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে মৌমাছির চাক। সারি সারি মৌমাছির চাক গাছগুলোর সাথে নিখুঁতভাবে লেগে থাকে। বনবিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে অভিযোগ ওঠে গাছ বিক্রি, টাকার বিনিময়ে মধু আহরণ ও অবৈধভাবে মাছের জন্য চর ইজারা দেওয়ার। এসব ঘটনার জন্য বেশ কয়েকবার শাস্তি পেতে হয়েছে কিছু অসাধু কমকর্তাকে।
সম্ভবনাময় পর্যটন শিল্প সোনারচর ও জাহাজ মারা উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে শুধু যোগাযোগ সমস্যার কারণে। পর্যটকদের আগ্রহ থাকলেও যোগাযোগ জটিলতায় পৌঁছাতে সমস্যা হয়।
সোনার চরে বিস্তীর্ণ বনভূমির পাশাপাশি রয়েছে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। সূর্যের আলোয় চিকচিক করে বালি। কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, গোলপাতা, বাইন, পশুর, ঝাউসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের সমাহার রয়েছে এখানে। কান পাতলে ঝাউবাগানে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায়। মনে হয় যেন নিখুঁত কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে এই সুর বাজানো হচ্ছে। শেষ বিকেলে মনোরম সৈকতে শুরু হয় লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। এখানে আসা পর্যটকরা লাল কাকড়ার সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠে। যেমনটি মেতে উঠে নদীর ছোট-বড় ঢেউয়ের সাথে। এ এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের প্রাণকেন্দ্র। এছাড়া দ্বীপটিতে রয়েছে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী।
বিশেষ করে শীত মৌসুমে ১০ লক্ষাধিক অতিথি পাখির সমাগম ঘটে এখানে। অতিথি পাখির আগমন সোনারচরকে এক নতুন রূপ দেয়। অতিথি পাখির কলরব আর সাগরের ঢেউয়ের গর্জনে মুখর হয়ে ওঠে সোনার চরের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
রাঙ্গাবালী উপজেলায় মৌডুবী ইউনিয়নে সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাজমারা সৈকত এখন সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে তদারকি করা হলে পর্যটন শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এই অঞ্চল।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে একটু হিমশিম খেতে হয় উপজেলা প্রশাসনের। ইউনিয়নগুলো বিছিন্ন থাকায় সময়মতো পৌঁছানো যায় না। অপরাধীরা তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংগঠিত করতে কিছুটা সময় পায়। রিমোট এরিয়া হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় অপরাধীরা এসে এই এলাকায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। স্থানীয় প্রশাসনকে এই বিষয়টিও সামাল দিতে হয়। বিছিন্ন ইউনিয়ন চরমোন্তাজ এর জন্য রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি।
তবে এই অঞ্চলে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে।
এ এলাকাগুলোতে যদি সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায় তবে এই মানুষগুলোকে সোনায় রূপান্তর করা যাবে। চ্যালেঞ্জিং এরিয়াগুলোতে সচেতনতা তৈরিতে এ এলাকার সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, মানবাধিকারকর্মীসহ সচেতন মহল কাজ করছে। সচেতনতা তৈরি করে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।
Discussion about this post