গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা যত নীতিকথাই আওড়াই, দুনিয়া জুড়েই তা এক সোনার হরিণ। দেশভেদে এ হরিণের চাকচিক্যে হয়তো তফাৎ আছে। আর তা মাপার জন্যও রয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। গণমাধ্যমেই সেসব পরিমাপের প্রকাশ-প্রচার হয়। কোনো দেশের হরিণের চাকচিক্য বেশি, কার হরিণের সোনা কতোটা খাঁটি, তা নিয়ে চলে নানান কিসিমের বাকবিতণ্ডা। গণমাধ্যমই আবার সে তথ্য আমাদের জানায়।
হরিণটার চাকচিক্য কিংবা মূল্যমান বিচার করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই, এর কোনো নিজস্ব রূপ আছে কি না? আমরা ভুলে যাই, হরিণটার মালিক ছাড়া অন্যদের কাছে এর মূল্যমান শূন্যের চেয়ে বেশি কি না? আমরা ভুলে যাই, হরিণটার বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে গাল-গল্প শোনা ছাড়া বাদবাকীদের আর কিছু করার আছে কি না ? গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এমনই এক গোলকধাঁধার মধ্যে রয়েছে।
বলা হয়, গণমাধ্যমের কাজ হলো কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়া এবং নির্মোহভাবে সঠিক তথ্য তার ক্রেতা-ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। একই সাথে তথ্য প্রবাহের অবাধ গতি-প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে তথ্যটির প্রয়োজন, গুরুত্ব এবং গুনগত মান যাচাই-বাছাই করা। স্বাধীনভাবে পরিচালিত না হলে এ প্রক্রিয়া কার্যকারিতা হারায়। গণমাধ্যমের বোদ্ধাজন এমনটাই মনে করেন।
গণমাধ্যমের অধরা স্বাধীনতার সাথে ক্ষমতাকাঠমোর সম্পর্ক নিয়ে নানান আলাপ রয়েছে। ক্ষমতার রাশ ধরা কর্তারা জনগণের কাছে কতটুকু স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক হবেন তার ওপর নাকি নির্ভর করে এ স্বাধীনতা। এসবই কেতাবি কথা, শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু তাতে স্বাধীনতার দেখা মেলে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যেসব ছিঁটেফোঁটা উদাহরণ হাজির করা হয়, তাও অলীক-অধরা সোনার হরিণের গল্পের মতোই শোনায়।
স্বাধীনতার অধরা হরিণটা যখন রূপকথার গল্প থেকে গণমাধ্যমের মালিকের খাঁচায় ঢোকে তখন সে তার মালিকের কাছে অতীব মূল্যবান হয়ে যায়। মালিক জনেন, হরিণটা তার মুনাফাকে কীভাবে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। গণমাধ্যম তো আখেরে ব্যবসা বৈ অন্য কিছু নয়, আর তার মুনাফা বাড়াতেই ‘স্বাধীনতা’ নামের সোনার হরিণের গল্প ফাঁদা হয়।
এ কথা সবারই জানা, সারা দুনিয়ায় গণমাধ্যমের মালিকানা সম্পদশালীদের হাতে বন্দি। যার গাঁটছড়া ক্ষমতাকাঠামোর সাথে বাঁধা। গণমাধ্যম তাদের কাছে কেবল একটি ব্যবসা নয় বরং ব্যবসা বাড়ানোর, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার, ক্ষমতাকাঠামোর কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের মাধ্যম। ক্ষমতাকাঠমোর কাছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছেলে ভোলানো গল্প ছাড়া আর কিছু নয়।
বোদ্ধাজনেরা আরও দাবি করেন, বর্তমান দুনিয়ায় তথ্য প্রবাহের অবাধ গতি-প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি। তার জন্যে প্রয়োজন গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভের একটি গণমাধ্যম। স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে এ স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে পড়ে। অন্য তিনটি স্তম্ভের ক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য। এ স্তম্ভগুলো নিজেদের মধ্যে টানাহেঁচড়ায় লিপ্ত হলে গণতন্ত্র স্বাভবিক গতি হারায়।
শ্রেণীকক্ষের পাঠ, পদ্ধতিগত গবেষণাকর্ম, গুরুগম্ভীর আলোচনায় কথাগুলো হয়তো মানিয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতায় এসবের সমন্বয় দুষ্কর। যারা এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন, যারা ক্ষমতাকাঠামোর উচ্চাসনে বসে কলকাঠি নাড়েন, তাদেরও তা ঢের জানা। বাস্তবতা হলো, ব্যবসায়ীদের সমর্থন-সহযোগিতা ছাড়া ক্ষমতাকাঠামোয় টিকে থাকা যায় না।
ব্যবসায়ীদের কাছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চেয়ে মুনাফা মূল্যবান। তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় যদি মুনাফা বাড়ে তাহলে তাদের আপত্তি করার কোনো কারণ থাকে না। অন্যদিকে ক্ষমতাকাঠামোও যতোক্ষণ গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় উপকৃত হয় ততক্ষণ সে একে কাছে টানে। আবার স্বাধীনতায় ক্ষমতাকাঠামো নড়বড়ে হয়ে ওঠার বিপদ দেখলে নানান বিধিনিষেধের শেকলে তাকে বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
হালফিল তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে গণমাধ্যমকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। গণমাধ্যমে এখন ভাগ বসাচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক মাধ্যম। নতুন মাধ্যমের ক্রেতা-ভোক্তদের বোঝাপড়াও ভিন্নরকম। ব্যবসায়ীদের কাছে সামাজিক মাধ্যমও যথারীতি মুনাফা বৃদ্ধির উপায় মাত্র। তবে এ মাধ্যমে মতপ্রকাশের কৌশল যেহেতু ভিন্ন, তাই ক্ষমতাকাঠামো একে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নতুন নতুন বিধিনিষেধের শেকলে।
নতুন মাধ্যমটির বহুবিধ ঝুঁকিও রয়েছে। গণমাধ্যমের মতো সামাজিক মাধ্যমে তথ্যের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব কিংবা গুণগতমান যাচাই বাছাইয়ের কোনো বালাই নেই। নতুন মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ অন্যরকম বিভ্রাট তৈরি করেছে। ভুল, ভূয়া কিংবা বানোয়াট তথ্যপ্রবাহের রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। এ সঙ্কট নিয়ে গণমাধ্যমের ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
ক্ষমতাকাঠামোও খানিকটা বিপাকে পড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তাৎক্ষণিক, মুখরোচক, সেনসেশনাল তথ্যপ্রবাহকে ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। লোহকে লোহা দিয়ে কাটতে হয়, ক্ষমতাকাঠামো তা জানে। তারাও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছে। আবার এর রাশ টেনে ধরতে তৈরি করছে নানান বিধিনিষেধের শেকল। এসব বিধিনিষেধ ব্যবহার তারা করছে নিজেদের খেয়াল-খুশি মফিক।
প্রত্যাশা ছিল, প্রযুক্তির উৎকর্ষ সমান্য হলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। সে আশা পূরণ হয়নি, উপরন্তু সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা তাদের ব্যক্তিগত স্বধীনতাটুকুও নিজের অজান্তেই খুইয়ে বসে আছে। সব দেয়াল ভেঙে অন্তর্জাল ব্যক্তির গোপন অন্দরে গিয়ে হানা দিচ্ছে। এ স্বাধীনতা হরণের সাথেও মুনাফা জড়িত।
সামাজিক মাধ্যম একাই স্বাধীনতা হরণ করে না, এখানেও ক্ষমতার খড়গের সাথে তাকে পাল্লা দিয়ে লড়তে হয়। সঠিক তথ্য জানার জন্য, নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য, এ লড়াই-সংগ্রাম সত্যিকার অর্থে কোনো কাজেই আসে না। বাজার অর্থনীতিতে টাকা থাকলে সব পণ্য কেনা যায়, কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বন্দি হয়ে থাকে ক্ষমতাকাঠমো এবং লাগামহীন মুনাফার কাছে।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক
Discussion about this post