ইদানিং বাংলাদেশে পেশা অনুযায়ী অনেককে আমরা নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে দেখি না। ব্যাপারটি ঘটছে তিনভাবে।
এক. ব্যক্তির ওপর যে অর্পিত দায়িত্ব তা তিনি পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
দুই. তিনি স্বেচ্ছায় পালন করছেন না। এবং
তিন. তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না ।
যারা কর্তব্য পালনে সচেষ্ট তারাও নিগৃহীত হচ্ছেন নানাভাবে। আইনজীবী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককেও আমরা দেখছি নিজ নিজ পেশাগত পরিচয়ে থেকেও নির্লজ্জভাবে দলীয় কর্মীরও অধিক দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন করতে। পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আদালতের বিচারক, দুদকের কর্মকর্তা, নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গও রাষ্ট্র ও সংবিধান কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ভুলে প্রায়শই দলীয় কর্মীর চেয়ে অধিকতর দলীয় কর্মীর ভূমিকা পালন করছেন। অদ্ভুত নজিরবিহীন বিশৃঙ্খল অনাচার চলছে দেশে।
কবি, সাহিত্যিক, লেখকরাও বাদ নেই। তারাও যেন দলীয় কর্মীরও অধিক দলীয় কর্মী এদেশে এখন। এটি যে খুব বেশি দোষের তা আমি বলি না। প্রত্যেকেরই দলপ্রীতি থাকতেই পারে। আবার রাজনৈতিক দল এমত পরিচয় ও পেশার মানুষকে তার দলে টানতেই পারে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। সমস্যাটা সেখানে নয়। সমস্যা হচ্ছে পরিচয়ের দ্বৈরথে। ব্যক্তির ভূমিকার ওভারল্যাপিংয়ে। ব্যক্তির কোন ভূমিকাটি কখন মুখ্য বা প্রধান, তার ডিলেমা সংকটকে তীব্র করে তুলছে। আপনি আপনার দলকে ভালবেসে সেবা দিতেই পারেন। কোনো অসুবিধা নেই তাতে। কিন্তু আপনি রাষ্ট্রের বেতন নিয়ে দলীয় কর্মীর আচরণ করতে পারেন না। এটি অনৈতিক ও বেআইনি। সংসদীয় গণতন্ত্রে দলীয় শাসনের সংস্কৃতি কাঙ্ক্ষিত। তবু সেখানে নির্বাচিতদের সার্বজনীন হতে হয়। নির্বাচনের পরে তিনি আর দলের থাকেন না। তিনি তখন সবার প্রতিনিধি। গণতন্ত্রে এজন্যেই গোপন ব্যালটে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলে। যারা প্রকাশ্যে দল করেন তারাও তা করতে দ্বিধা করেন না এই বিশ্বাস থেকে যে নির্বাচনের পর যিনি বিজয়ী হবেন তিনি সবার প্রতিনিধি হবেন। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। অর্থাৎ একজন দলীয় কর্মী ও নেতার কখনো কখনো নির্দলীয় হবার দায় তৈরি হয়। রাজনৈতিক নেতাকেও নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। গণতন্ত্রে এটাই রীতি। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু এদেশে এখন আমরা কী দেখছি? এখানে এখন রাজনৈতিক নেতা নির্বাচিত হওয়ার পরে নৈর্ব্যক্তিক তো হচ্ছেনই না উল্টো যাদের নৈর্ব্যক্তিক থাকার কথা সেই আমলাতন্ত্রকে বাধ্য করছেন দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করতে। নগদ লক্ষ্মীর সংস্কৃতিতে নারায়ণ প্রিয় আমলাদের আর দোষ দিয়ে কী হবে! এভাবেই চলছে কিম্বা আসলেই চলছে না। কী একটা ভয়ংকর ভজকট অবস্থা!
সংসদীয় গণতন্ত্রে ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসেন। তিনি দলীয় পরিচয়ে বা স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচিত হতে পারেন। নির্বাচিত হবার পরে তিনি তার নির্বাচনী এলাকার সমগ্র নাগরিকের প্রতিনিধি। এটিই আদর্শ বা ন্যায় সঙ্গত কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক আচরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যে দলের সেই দল সরকার গঠন করে। সংখ্যালঘিষ্ঠরা বসে বিরোধীদলে।
সংসদীয় কার্যপ্রণালী দ্বারা সংসদ পরিচালিত হবে এটিই নিয়ম রীতি বা সংস্কৃতি। সরকারি দলের যারা মন্ত্রী হন তারা দলের আরও ঊর্ধে চলে যান। তারা রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পান। নাগরিকের করের টাকার নায্য বণ্টনে তারা দায়বদ্ধ থাকবেন এটিই নাগরিকের ন্যায় সঙ্গত চাওয়া। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটিই নিয়ম। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দলীয় কর্মীরও দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধে ওঠা ন্যায় সঙ্গত। কিন্তু আমরা বর্তমানের বাংলাদেশে কী দেখছি? রাজনৈতিক কর্মী রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হয়ে দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলত যা ঘটবার তাই ঘটছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আইনের চেয়ে আচরণ মুখ্য। ব্যক্তি যখন দলে তখন তার ভূমিকা আর তিনি নির্বাচিত হয়ে যখন সংসদে তখন তার আর এক রকম ভূমিকা। আবার তিনি যখন মন্ত্রী হয়ে সরকারে তখন তার ভূমিকা আলাদা। রাজনীতিবিদকে খুবই সচেতনভাবে এটি আলাদা করতে জানতে হয়। তিনি যদি এটি না করতে পারেন তবে গণতন্ত্রের সৌন্দর্যহানি হয়। বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতিতে এই সংস্কৃতি অধরাই রয়ে গেল। দলীয় প্রধান নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হন। আবার তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদ নেতা হন। তিনিই আবার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেন। অর্থাৎ ব্যক্তি এখানে একজন হলেও পদ ভেদে তার আলাদা আলদা ভূমিকা ঠিক করা আছে। ব্যক্তি তার পদের ভূমিকা অনুযায়ী কাজ করতে না পারলে চরম অনিয়ম ঘটে। সুশাসন বিঘ্নিত হয়। গণতন্ত্রের সুফল তখন আর হাতের নাগালে থাকে না। এমত পরিস্থিতির রমরমা এখন বাংলাদেশে। রাজনীতিবিদ, বেসামরিক ও সামরিক আমলা, বিচারক, সুশীল সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উকিল, পুলিশ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে স্পিকার ও রাষ্ট্রপতিও দলীয় কর্মী সাজার প্রতিযোগিতায় দৌড়াচ্ছেন। অপলক। নির্দ্বিধায়। এইসব দেখে দেখে আমরা নিয়ম রীতি ও আচার ভুলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে এটিই নিয়ম বা আচরণ। আর গোল বাধছে তখনই। একটা সভ্যদেশে এটা চলতে পারে না। এটি বর্বর, জঙ্গলি, বুনো ও হিংস্র শাসনের নামান্তর। দুঃশাসনের দুর্বিপাকে বাংলাদেশ। আর নাগরিক হিসেবে যে সক্রিয়তা জরুরি তাও আজ নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে ভয় ও লোভে নির্লিপ্ত নির্বিকার।
শুধু ব্যক্তি নয়। রাষ্ট্রের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের ভূমিকা পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে পেশাদারিত্ব নিখোঁজ প্রায়। অপেশাদারি আচরণ দেখে দেখে আমরা সঠিক দায়িত্ব ভুলতে বসেছি আজ। রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান আজ দলীয় ক্যাডারে ভরপুর। ব্যক্তি, দল, সরকার ও রাষ্ট্র আজ মিলেমিশে একাকার এখানে এখন। কী একটা হযবরল অবস্থা! এই অবস্থার যত দ্রুত অবসান ঘটবে নাগরিকের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র নির্মাণ ততোই ত্বরান্বিত হবে। গণতন্ত্রে যখন ভোটের সংস্কৃতি ভুলণ্ঠিত হয়, রাজনীতিবিদ যখন জনগণের রায়ে আস্থা হারান, সেবা নয় লুটপাট ও পেট পকেটের রাজনীতি যখন নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় তখন আশাহীন মানুষ আর নিয়মে আস্থা রাখতে পারে না। তখন তারা নিজেদের দুর্বল ভাবতে শুরু করে। আর তখন নাগরিকসত্ত্বা মরে মরে প্রজাসত্ত্বা বিকশিত হয়। আর তখন তৈরি হয় দুঃশাসনের দুষ্টচক্রের জাল। তখন আমজনতার অন্তরে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে তুষের আগুন। আবার সেই আগুন লেলিহান শিখাও হয়ে যেতে পারে যখন-তখন। সমবেত মানুষের ঐক্যই কেবল এই দুষ্টচক্রের জাল ছিন্ন করতে পারে।
Discussion about this post