৫ নভেম্বর রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩ সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলা হলেও দুটি নির্বাচনেই ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি, জাল ভোট ও ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠেছে।
এ কে এম শাহজাহান কামালের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে উপ-নির্বাচনে চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে গোলাম ফারুক পিংকু (নৌকা), জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ রাকিব হোসেন (লাঙ্গল), জাকের পার্টির শামছুল করিম খোকন (গোলাপ ফুল) ও ন্যাশানাল পিপলস পার্টির সেলিম মাহামুদ (আম)।
ভোটগ্রহণ চলাকালে ‘অনিয়মের’ অভিযোগ তুলে চার প্রার্থীর মধ্যে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ রাকিব হোসেন এবং জাকের পার্টির শামছুল করিম খোকন ভোট বর্জন করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপির দলছুট নেতা আব্দুস সাত্তার ভূইয়ার মৃত্যুতে এই আসনটিকে শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
রোববার দিনভর ভোট শেষে রাত ৯টায় জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহগীর আলম এ ফলাফল ঘোষণা করেন। তাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) সংসদীয় আসনে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শাহজাহান আলম বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হন।
শাহজাহান আলম নৌকা প্রতীকে ৬৬ হাজার ৩১৪ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জিয়াউল হক মৃধা কলার ছড়ি প্রতীকে পেয়েছেন ৩৭ হাজার ৫৫৭ ভোট। মৃধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।
কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে ‘ওপেন ভোট নেওয়ার পাশাপাশি জাল ভোট দেওয়ার’ অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মৃধা।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই উপনির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর একটি সংসদ অধিবেশন পাওয়ার সম্ভাবনাও নাই। তবু সরকারি দলের প্রার্থী বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে একজন ছাত্রলীগ কর্মী ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩টি ভোট দিয়েছেন।
নিয়মরক্ষার নির্বাচনে যদি এমন হয় তবে যে নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্ন থাকে, সেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা কী করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ গোটা বাংলাদেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু তারা এই সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া বর্জন করেছে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে যে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকার বলছে, তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। কিন্তু কীভাবে!
এই সরকারের অধীনে অন্যান্য সকল নির্বাচন বাদ দিয়ে আমরা যদি ২০১৮ সালের জাতীয় সাংসদ নির্বাচনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, দিনের ভোট আগের রাতেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার ক্ষেত্রে লেভেল প্লেইং ফিল্ড বলে কিছু ছিল না। গোটা নির্বাচনকালীন সময়ে- মনোনয়ন পত্র দাখিল করার সময়কাল থেকে শুরু করে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিরোধী কোনো প্রার্থী ভোটের মাঠে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারেননি।
১৮ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে আমি ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে পিরোজপুর পর্যন্ত যাওয়ার এই দীর্ঘ পথে নৌকা ও হাতপাখা ছাড়া অন্য কোনো দলের কোনো প্রার্থীর পোস্টার দেখতে পাইনি। তাহলে এই দুটো দল ছাড়া অন্য কোনো দল কি ভোটের মাঠে ছিল না? বিশেষ করে বাংলাদেশের অন্যতম বড় ও জনপ্রিয় দল বিএনপি কি নির্বাচনের মাঠে ছিল না? বা তাদের প্রার্থীর কি কোনো পোস্টার ছিল না? ছিল। তবে নির্বাচনের পরিবেশ ছিল না। পোস্টার টাঙালেই তা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। কোথাও বিরোধী নেতা-কর্মীদের একদণ্ড দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর প্রত্যক্ষ হামলা ছাড়াও, বিরোধী প্রার্থী ও সমর্থকরা পুলিশী হামলা ও মামলাসহ প্রতিনিয়ত নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
ভোটের পরে আওয়ামীলীগ নেতাদের বিভিন্ন সময়ে বলতে দেখা গেছে যে, ‘বিএনপি জোট সেই সময়ে এক আসনে একের অধিক প্রার্থী দিয়ে দলের মধ্যে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, এমতাবস্থায় বিএনপি কীভাবে নির্বাচনে জয়ের আশা করে!’
বিএনপি শখ করে এক আসনে একাধিক প্রার্থী দেয়নি। দিতে বাধ্য হয়েছে। এর আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ের নামে অনেক বিরোধী প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল হয়ে গেছে। তাদের নির্বাচনের ময়দান ফেলে ঘুরতে হয়েছে কোর্টের বারান্দায়। নির্বাচন কমিশনের এহেন আতশ কাঁচের নিচে ফেলে যাচাই-বাছাইয়ের ঝুঁকি এড়াতেই বিএনপিকে হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তবে ওইসব বিকল্প প্রার্থীরাও এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং দু’একজন ব্যতিরেকে কেউ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন এমন নজির নেই। তবে নজিরবিহীন বৈষম্যমূলক আচরণ ছিল প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের।
বিরোধী প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা, মামলা, প্রচার-প্রচারণায় বাধা সহ এমন একটা ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল যে ভোটাররা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হলেও দিনের বেলা ভোট কেন্দ্র দখল, বিরোধী প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নোয়াখালীর সূবর্ণ চরে ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়। যা মূলত নারী ভোটারদের প্রতি প্রত্যক্ষ হুমকি ছিল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক নারীই এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ভোট কেন্দ্রে যেতে দ্বিধান্বিত হবেন।
এছাড়া রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া নিরপেক্ষ প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচন নিয়ে প্রহসনের চিত্র ক্ষমতাসীন সব সরকারের বেলাতেই কম-বেশি দেখা গেছে। যে ব্যক্তি বা দল ক্ষমতায় আরোহন করেছে, তারাই তাদের সুবিধা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে।
কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের প্রথম কর্তব্য হলো, দেশের ছোট বড় সকল রাজনৈতিক দলের সাথে গঠনমূলক আলোচনার ভিত্তিতে, সবার জন্য গ্রহণযোগ্য কিছু গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক আবহ তৈরি করা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল সরকারে থাকলে নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করে যা বিগত সময়ে আমরা দেখে এসেছি এবং দেখছি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যে চারটি নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত হয় -১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১, ২০০৮ এই চারটি নির্বাচনই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমন নির্বাচন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভব না বলে সবাই মনে করছেন।
এমতাবস্থায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষায় রাজনৈতিক সংগঠনগুলো একটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করছে।
কিন্তু বর্তমান সরকার ও তার মনোনীত নির্বাচন কমিশনকে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক দলের সাথে সমান আন্তরিকতা ও সমান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনো গঠনমূলক আলোচনায় কখনোই আগ্রহী দেখা যায়নি। বিরোধী দলগুলোর প্রতি সরকারের দমন-পীড়ন, গুম, খুন বাদ দিলেও একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনও বারংবার বিমাতাসুলভ প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ করে চলেছে। যা একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তরায়।
গাজী তানজিয়া : কথাসাহিত্যিক
Discussion about this post