পাশাপাশি দুটি খবর। প্রথমটি সোমবারের (৪ আগস্ট)। খবরটি হলো, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মুখতার ইলাহী হলের ডাইনিং টানা আট দিন ধরে বন্ধ। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন হলে বসবাসরত প্রায় চারশ শিক্ষার্থী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ডাইনিং বন্ধ বলে জানিয়েছে হল কর্তৃপক্ষ।
তার আগে ৩১ আগস্টের খবর অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো চলছে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জন্য তিনি আবারও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। অর্থমন্ত্রী এও বলেন, ‘যারা বলছেন দেশের অর্থনীতি ভালো নেই, তারা অর্থনীতিই বোঝেন না।’
সাধারণ মানুষ অর্থমন্ত্রীর মতো করে অর্থনীতি বুঝবেন না এটা স্বাভাবিক। কারণ তাদের অর্থনীতি আলাদা। তারা চাকরি বা কাজ করেন, বেতন পান, সরকারকে ট্যাক্স দেন। তাদের প্রত্যাশা নিজের সাধ্যের ভেতর বাজার-সদাই করতে পারবেন, কিছু সঞ্চয় করতে পারবেন আর নিরাপদে থাকতে পারবেন। কিন্তু সাধারণ জনগণের সেই আশার গুড়ে যে বালি পড়ে আছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কিছু নেই। অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। তা কতটা বেড়েছে সেটা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরটি দিয়েই বোঝা যায়।
অর্থমন্ত্রী যে বলেছেন জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী, সাধারণ মানুষ হয়তো এ ‘অর্থনীতি’ বুঝতে পারে না। কিন্তু অর্থনীতিবিদ যারা, বাজার নিয়ে যারা সরাসরি কাজ করছেন, তারাও অর্থমন্ত্রীর এ কথা মানতে নারাজ।
যেমন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান একই দিনে (৩১ আগস্ট) বলেছেন, ‘ক্যাবিনেটে ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী। সংসদ ও সরকারের মধ্যে রাজনীতিবিদদের তুলনায় ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য থাকলেও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, মনিটরিংয়ে তার প্রতিফলন নাই। দাতাদের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার ও মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করলেও মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা ফ্রাংকেস্টাইন হয়ে গেছে। তাদের কঠোর হাতে রুখতে হবে।’
তিনি বলেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের আগুনে দাহ হওয়া ভোক্তাদের কেবল বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। সরকার বলছে সিন্ডিকেট নাই। কিন্তু কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে সেটা কি সিন্ডিকেট নয়।’ (ইত্তেফাক)
এই দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষকে কতটা করুণ অবস্থায় ফেলেছে তা জানা যায় আমাদের সময় ডটকমের এক প্রতিবেদনে। সংবাদমাধ্যমটির বরিশাল প্রতিনিধির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রান্নার জন্য তরকারি, তেল ও চাল কিনতে পোর্ট রোড বাজারে আসেন এক নারী। প্রথমে চাল আর তেল কিনতে গিয়ে হতাশ হন তিনি। এক কেজি চালের দাম জিজ্ঞেস করলে দোকানি ৬০ টাকা বলেন। সেখান থেকে হাঁটা শুরু করে অন্য দুটি দোকানে গিয়ে জানতে পারেন নিম্নে চালের কেজি ৫০ টাকা। কিন্তু এত দামে চাল কেনার টাকা না থাকায় তিনি শুধু ২০ টাকার মসুর ডাল কিনেই ফিরে যান’।
গৃহকর্মীর কাজে নিযুক্ত থাকা ওই নারী বলেন, ‘দাম বেশি থাকায় চাল কিনতে পারি নাই। এখন প্রতিবেশি কারও কাছ থেকে একটু চাল ধার করে রান্না করতে হবে। আগে গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালাতে পারলেও এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় কেউ কাজেও রাখতে চান না’।
এই নারী যে একাই এমন পরিস্থিতে আছেন তা নয়। সম্প্রতি এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপের তথ্য সেটা প্রমাণ করে। ওই জরিপে জানা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন বাংলাদেশের অর্থনীতি ভুল পথে চলছে।
ডয়চে ভেলে বাংলার এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকোন পথে রয়েছে- এমন প্রশ্নে ৬৯.৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানায়, অর্থনৈতিকভাবে দেশ ভুল পথে আছে। সঠিক পথে রয়েছে বলে জানিয়েছে ২৫.২ শতাংশ উত্তরদাতা। এই একই জরিপ তারা আগেও করেছিলেন। ২০১৯ সালে করা জরিপে ৭০.৩ শতাংশ নাগরিক মনে করত, বাংলাদেশের অর্থনীতি ঠিক পথে রয়েছে আর ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করত ভুল পথে রয়েছে । কিন্তু এখন সেই মতামত অনেকটাই উল্টে গেছে।
তারা জানায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। দেশের ৮৪ শতাংশ মানুষের জীবনে এ সমস্যা গুরুতর প্রভাব ফেলেছে বলে জরিপে জানা গেছে। কিছুটা প্রভাব ফেলেছে ১৩ শতাংশ মানুষের জীবনে। বাড়তি দ্রব্যমূল্য জীবনে প্রভাব ফেলেনি এমন মানুষ রয়েছে কেবল ১ শতাংশ। মোটেও আঘাত পায়নি এমন লোকও রয়েছে ২ শতাংশ। ৪৪ শতাংশ মনে করছে, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি।
এ বিষয়ে সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, জরিপে বাংলাদেশের অর্থনীতির বাস্তব অবস্থাই প্রতিফলিত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যই বাংলাদেশের মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় ফেলেছে। আর অর্থনীতির সূচক দেখলেও স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে যাচ্ছে না।
আর পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দিয়ে আর কত চলবে? বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমে আসছে। আমাদের কমছেনা। ডাবের দাম, ডিমের দাম বাড়ার কী কারণ থাকতে পারে? আসলে আমাদের সঠিক নীতি নির্ধারণের অভাবে এই সংকট হয়েছে। আমার মনে হয় অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে। রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বাড়বে। কারণ সংকট কাটাতে দৃশ্যমান কোনো নীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
চলতি সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে মাছের দাম এখনো চড়া। রুই ও কাতলা মাছ কেজি ৩৫০-৪৫০ টাকা, মাঝারি ও বড় চিংড়ি ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, ছোট চিংড়ি ৮০০ টাকা ও পাঙাশ মাছ ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় দেড় হাজার টাকার আশপাশে।
মুরগির মধ্যে ব্রয়লার ১৭০-১৮০, সোনালি ৩০০-৩৩০ ও দেশি প্রজাতির মুরগির কেজি ৪৮০-৫০০ টাকা বিক্রি হয়। এ ছাড়া গরুর মাংস ৭৫০-৭৮০, বকরি ৯০০ ও খাসির মাংস ১ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
Discussion about this post