গত ২৩ সেপেটম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ শুরুর ঘোষণা দেয়। ২৫ সেপ্টেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কথা বলেন ঢাকায় রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। পিটার হাস বেশ খোলামেলাভাবেই কথা বলেছেন। তবে বারবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া ব্যক্তিদের সংখ্যা বা নাম বলেননি। বলেছেন, বিষয়গুলো প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে।
বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বুঝতে রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকারটি বেশ সহায়ক। যদিও ওই সাক্ষাৎকারের পর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় ছিল গণমাধ্যমের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসার প্রসঙ্গটি। গণমাধ্যম বলতে বোঝানো হয়েছে, গণমাধ্যমে কর্মরত ব্যক্তিদের। বলা হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি কাজ করবে। যে নীতির কথা এ বছরের ২৪ মে থেকে বলে আসছে দেশটি।
২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী নতুন যে ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকারী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। প্রকাশ্যে ঘোষণার আগে এ বছরের ৩ মে তারিখে যুক্তরাষ্ট্র নতুন এই ভিসানীতি বিষয়ে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এর আগে এপ্রিলে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। বৈঠকে ব্লিঙ্কেন বলেন, বাংলাদেশে যাতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বিধি-নিষেধ ঘোষণার আগে সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বিষয়টি জানায়। যেমনটা র্যাবের ওপর স্যাংশন আরোপের আগে জানানো হয়েছিল। ফলে নতুন ভিসানীতি ঘোষণার আগে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিতভাবে জেনেছে। গত শুক্রবার ভিসানীতি আরোপ শুরুর ঘোষণার পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও জানান যে, এ বিষয়ে তাদের আগে থেকে জানানো হয়েছিল।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর, ২০২৩ সালের ২৪ মে ভিসানীতি ঘোষণা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর সময়ে ২৩ সেপ্টেম্বর সেটি কার্যকর করার প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের অবস্থানে কোনো হেরফের হয়নি। বাংলাদেশ বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরে তারা যে বক্তব্য দিয়ে আসছিল, সে বক্তব্যেও কোনো হেরফের দেখা যাচ্ছে না। বারবার তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বলছে। ভিসানীতি ঘোষণা থেকে শুরু করে আরোপ পর্যন্ত একই ভাষায় তারা কথা বলে এসেছে। আর এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং বিশেষায়িত ওই বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ তৎপর হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারের অজস্র সমালোচনা, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে নানা তৎপরতার সামনে মার্কিনীরা নমনীয় হয়নি।
এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকারসহ সুনির্দিষ্ট কিছু ইস্যুতে তৎপরতা চালিয়ে গেছে। মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের সঙ্গে অনেকগুলো বৈঠক করেছে তারা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে তারা বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন বাইডেন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকা এসেছিল এ বছরের জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে। দলে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু।
জানুয়ারির শুরুতেও ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসেন। তখন তিনি র্যাবের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টির কথা জানালে বাংলাদেশ-ওয়াশিংটন সম্পর্কের অস্বস্তি অনেকটা দূর হয়েছিল বলে মনে হয়েছিল।
তবে উজরা জেয়ার সফরে পুরাতন অস্বস্তি আবার ফিরে আসে। কারণ তিনিও সেই সুষ্ঠু নির্বাচনেরই আহ্বান জানান। মানবজমিনের খবরে বলা হয়, অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ- মোটাদাগে এই তিন শব্দ ব্যবহার করে বাংলাদেশে সত্যিকারের একটি নির্বাচন আয়োজনের স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছেন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধি দল।
আগস্টে আসেন মার্কিন কংগ্রেস সদস্য এড কেইস এবং রিচার্ড ম্যাকরমিক। তারাও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায় যাতে সারা বিশ্ব বলতে পারে দেশে একটি নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছে।
তাদের আগের সপ্তাহেই মার্কিন দুর্নীতিদমন বিষয়ক সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ ঢাকায় আসেন। তিনিও অনেকগুলো বৈঠক করেন এবং বলেন, স্যাংশন দুর্নীতি দমনের হাতিয়ার।
সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে অনেকগুলো বিষয়ে আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এ সময় তাদের অগ্রাধিকার হলেও তারা যে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচনই চায়, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্র শুধু নির্বাচন, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শ্রমিক অধিকার ইত্যাদি নিয়ে বৈঠক করেনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে।
এ কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে সক্রিয় দেখা গেছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) এবং জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া) ও দ্য অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা) নিয়েও। জিসোনিয়াম ও আকসা হচ্ছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংলাপে ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) বিষয়ক প্রতিরক্ষা চুক্তির অংশ। আগস্টের শেষ সপ্তাহে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, দুর্যোগ মোকাবিলা, শান্তিরক্ষা ও প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ, দুই দেশের সামরিক কর্মকর্তাদের সফর বিনিময়, জঙ্গিবাদ দমনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
পিটার হাস রোববার যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতেও বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে।
পিটার হাস পৌনে এক ঘণ্টার ওই সাক্ষাৎকারে কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন, যা আমলে নেওয়ার মতো। যেমন সামরিক চুক্তি বিষয়ে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর গভীর সম্পর্ক তৈরি হোক। এ গভীর সম্পর্ক শুধু উড়োজাহাজের ফুয়েল কেনা নয়, অস্ত্র কেনা নয়- বরং এর সঙ্গে রয়েছে সেনাবাহিনীকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সেসবের রক্ষণাবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ ইত্যাদি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র শুধু একটি বিষয়ে বাংলাদেশের অংশীদার হতে চায় না। তারা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে চায়। এমন তথ্য বিনিময় করতে চায়, যা শুধু দু’দেশের মধ্যেই থাকবে। এমন কৌশল নিতে চায়, যা পরস্পরের স্বার্থ রক্ষা করবে।
অর্থাৎ, একইসঙ্গে একাধিক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে অবাধ সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারবে না, বিশেষ করে যারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের জন্য সমস্যাজনক। এর বাইরে পিটার হাস রোহিঙ্গা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মিয়ানমারকেও একটা সমস্যা হিসেবে দেখিয়েছেন। মাদক পাচারে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কোনো পক্ষ যুক্ত বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, রোহিঙ্গাদের তখনই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব যখন তাদের জন্য মিয়ানমারে নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি হবে, এবং সেখানে নতুন করে কোনো গণহত্যার আশঙ্কা থাকবে না।
পিটার হাস তার সাক্ষাৎকারে টিকফা, আকসা, জিসোমিয়া চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। আকসা চুক্তি হয়নি বলেও তিনি জানিয়েছেন। এ ছাড়া শ্রমিক অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়েও আশাবাদী ছিলেন না তিনি। যে কারণে জিএসপি সুবিধা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো ভাবতে হবে বলে তিনি জানান।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে বিনিয়োগ বিষয়েও হতাশা জানিয়েছেন। পরিষ্কার ভাষায় তিনি বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে অনেক মার্কিন কোম্পানির বিল পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ। যে কারণে এখানে বিনিয়োগে ভাটা পড়ছে।
তবে এসব বিষয়ে উন্নতি করলে বা সামরিক চুক্তি হলেই যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আর নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন দেবে না তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার কূটনীতির মূলমন্ত্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরানসহ বিভিন্ন দেশেই গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। এসব দেশে ভাল নির্বাচন হয় না, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারও ভূলুণ্ঠিত। আর এসব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের বাইরে, গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই গণতন্ত্র সম্মেলন চালু করেন। বাইডেন প্রশাসন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ৬৯০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যার উদ্দেশ্য- মুক্ত সংবাদমাধ্যম, সুষ্ঠু নির্বাচন ইত্যাদি।
যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতির কারণে শুধু সামরিক চুক্তিতে সম্মত হলেই হবে না। বাংলাদেশকে সুষ্ঠু নির্বাচনও করে দেখাতে হবে। মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে না, এমন আশ্বাস দেননি পিটার হাস। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মানবাধিকার ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা তাদের ‘টুলস’। এই টুলস তারা কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে না। বরং কোনো দেশে যারা গণতন্ত্র চায় না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়, মানুষের অধিকার হরণ করে তাদের বিরুদ্ধে এ টুলস ব্যবহৃত হয়।
Discussion about this post