সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ডিএসএ পরিবর্তন করে তার জায়গায় ভিন্ন একটি আইন আনার সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইনটির নামকরণ করা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩।
নতুন আইনটি নিয়ে মতামত গ্রহণের জন্য তা তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। সর্বসাধারণের মতামত দেওয়ার জন্য সময় ছিল ১৪ দিন। এরপর সেপ্টেম্বরে সংসদ অধিবেশনে নতুন আইন পাশ হবে বলে আইনমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন যে, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল নয় পরিবর্তন করে নতুন সাইবার সিকিউরিটি আইন তৈরি হচ্ছে। যদিও এ পরিবর্তন নিয়ে ইতিমধ্যে আপত্তি উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বিলুপ্ত নয়, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
আইসিটি থেকে ডিএসএ
তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়। যেটি আইসিটি আইন হিসেবে পরিচিত হয়। সেই আইনে বলা হয়, বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা দেওয়া এবং আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে বিধান প্রণয়নের জন্য আইনটি করা হয়েছে।
২০১৬ সালে আইনটি সংশোধন করে আরো কঠোর করা হয়। এ আইনের অধীনে বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি বাড়ানো হয়। আইসিটি অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর থেকে আইনটির বিভিন্ন ধারা নিয়ে বির্তক তৈরি হয়। বিশেষ করে আইনটির ৫৭ ধারা বাতিলের তুমুল দাবি ওঠে।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে’।
এ অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল। এই ৫৭ ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও সাংবাদিকদের কারাগারে নেয়ার একাধিক ঘটনা তীব্র সমালোচনা তৈরি করে। সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের তরফ থেকে এটি নিবর্তনমূলক আখ্যা দিয়ে আইসিটি আইন বাতিলের দাবি করা হয়।
যার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের একটি নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। একই বছরের সেপ্টেম্বরে এটি খসড়াটি সংসদে আইন হিসেবে পাস হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে নতুন এ আইনে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বাতিল করে তার পরিবর্তে এসব ধারার অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হয়।
২০১৮ সালে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সংবাদপত্রের সম্পাদকরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। তারা সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনী আনার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। কর্মসূচিতে সাত দফা দাবি ঘোষণা করে সম্পাদক পরিষদ। সেগুলো হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা সংশোধন, কোনো সংবাদমাধ্যমের কম্পিউটার ব্যবস্থা জব্দ করার ক্ষেত্রে আদালতের আগাম আদেশ নেয়ার বিধান চালু করা, তথ্য অধিকার আইনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর প্রাধান্য দেয়া।
আর্টিক্যাল নাইনটিনের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, এ আইন কার্যকর হওয়ার দিন থেকে অর্থাৎ ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬৭০টি মামলা দায়ের হয়েছে। এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে ১১৩৬ জনকে। এরমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন ৪০৪ জন।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে ১১০টি। যাতে অভিযুক্ত হয়েছেন ২২৩ জন। গ্রেফতার হয়েছেন ৫৪ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে ৪০% মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পরিবার, মন্ত্রী, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল টার্গেট হয়েছেন সাংবাদিক না হলে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।
এ ছাড়া ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা, গুজব রটনা বা সরকারের সমালোচনা করা-এমন সব অভিযোগে এনেও আইনের অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে বলে সংগঠনটির জরিপে উঠে এসেছে। আইনটি পাস হওয়ার আগে থেকেই আশঙ্কা ছিল, আইনটির অনেক ধারায় হয়রানি ও অপব্যবহার হতে পারে। এমন কয়েকটি হয়রানিমূলক ধারা সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল আর্টিকেল নাইনটিন।
বিশেষ করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্নমত পোষণের বিষয়গুলো বাদ দেওয়া বা সেগুলো সুস্পষ্ট করা বিষয়ে যেসব দাবি ছিল বিভিন্ন মহলের, সেগুলো উপেক্ষিত হয়েছে বরাবরই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনেও এসব বিষয় বহাল থাকবে। এমনকি ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশি তল্লাশীর বিধানও রাখা হয়েছে। আগে ‘তুলে নিয়ে যাওয়া’, তারপর মামলা দেওয়া, সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠলেই মামলা, এমনকি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে।
তবে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দেওয়ার ঘটনাগুলো আরো নিপীড়নমূলক।
যেমন ২০২০ সালে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ঘটে। ওই বছরের মে মাসে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো।
এর মধ্যে লেখক মুশতাক আহমেদ কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান। এ আইনের ১৪টি ধারায় সংঘটিত অপরাধ অজামিনযোগ্য।
এ কারণে নয় মাস ধরে আটক থাকা লেখক মুশতাক আহমেদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছয় বার জামিন আবেদন করেও জামিন পাননি। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খদিজাতুল কোবরা জামিন না পেয়ে কারান্তরীণ রয়েছেন।
সাইবার সিকিউরিটি আইনে যা আছে
সাইবার নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২১ ধারা।
এ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালায় বা তাতে মদদ দেয় তাহলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হতো এবং এর জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
এই একই অপরাধ কেউ দ্বিতীয়বার করলে তার সাজা দ্বিগুণ করার বিধান ছিল। আর বারবার একই অপরাধের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল। এই ধারাটিতে পরিবর্তন এনে সাজার মেয়াদ ৭ বছর করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলেও সাজা দ্বিগুণ হবে না।
তবে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার থাকছে।
ডিএসএ এর ৪৩ ধারা নিয়ে বড় বিতর্ক থাকলেও সেটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে তার, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই সেখানে তল্লাশী, সরঞ্জাম জব্দ, দেহ তল্লাশী, এবং পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের এখতিয়ার রয়েছে।
এটি অপরিবর্তিত রাখার যুক্তি হিসেবে আইনমন্ত্রী বলেন, সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে, এসব অপরাধ যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে করা হয় সেটা জব্দ না করলে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেকারণে এটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮, ২৯, ৩০ ধারাগুলো বাতিলের বিষয়ে নানা সময়ে আহ্বানও জানানো হয়েছে। এ ধারাগুলো বাতিল করা না হলেও সেগুলোতে সংশোধন আনা হয়েছে বলে জানান আইনমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা সবসময়ই বলেছি যে বাতিল করা যাবে না। এগুলো সংশোধন করা হবে এবং সেটাই করা হয়েছে।”
ডিএসএ-র ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উস্কানি দেয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করে, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহলে তা অপরাধ হবে। এই অপরাধের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কারাদণ্ড, বা দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। একই অপরাধ বার বার করলে সাজা ও জরিমানার মেয়াদ দ্বিগুণ হওয়ার বিধান ছিল।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, এই ধারায় সাজা কমানো হয়েছে। এটা আগে ছিল অ-জামিনযোগ্য। এটা জামিন-যোগ্য করা হয়েছে।
ডিএসএ এর ২৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এ ছাড়া একই অপরাধ বারবার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
এই ধারায় পরিবর্তন এনে কারাদণ্ডের যে সাজা ছিল সেটাকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এখানে শাস্তি হবে শুধু জরিমানা। আর জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।
আইনমন্ত্রী বলেন, সর্বোচ্চ জরিমানা ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করা হবে।
তিনি বলেন, দেওয়ানি আইনে কেউ মানহানির জন্য মামলা করলে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কোন সীমা নাই। তিনি চাইলে ১০০ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। তবে সেটা কমিয়ে সর্বোচ্চ আদায় যোগ্য জরিমানার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। তবে কত টাকা জরিমানা করা হবে তা নির্ধারণ করবে আদালত।
মানহানির মামলায় এখন যেহেতু কোন কারাদণ্ড নাই, তাই এই ধারায় কাউকে গ্রেফতারও করা যাবে না বলে জানান আইনমন্ত্রী।
ডিএসএ’র ৩১ ধারায় এর আগে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৭ বছর এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। একাধিক বার একই অপরাধ করলে সাজা বেড়ে ১০ বছর এবং জরিমানা ১০ লাখ টাকা করার বিধান ছিল।
এ ধারায় পরির্বতন এনে সাজার সময়-সীমা কমানো হয়েছে। আগে সাত বছরের কারাদণ্ডের পরিবর্তে এটা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। বার বার একই অপরাধ করলে সাজা বাড়ানোর বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে।
ডিএসএ’র ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের শাস্তি আগে ছিল ১৪ বছর, সেটি কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। বারবার এই অপরাধ করলে সাজা বাড়ার বিধান বাতিল করা হয়েছে। আর ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
হ্যাকিং হচ্ছে, কম্পিউটার তথ্য ভাণ্ডারের কোন তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তন বা তার মূল্য বা উপযোগিতা কমানো বা অন্য কোন ভাবে ক্ষতিসাধন বা নিজ মালিকানা বা দখল বিহীন কোন কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে তার ক্ষতিসাধন হবে হ্যাকিং।
ডিএসএ’র ৩৩ ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা ডিজিটাল সিস্টেমে বে-আইনিভাবে প্রবেশ করে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো আর্থিক বা বাণিজ্যিক সংস্থার কোনো তথ্য-উপাত্তের কোনো ধরনের সংযোজন বা বিয়োজন, স্থানান্তর বা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তা অপরাধ বলে ধরা হবে।
ডিএসএ’র বিভিন্ন ধারা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনার পর পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্তে তারা সন্তুষ্ট হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘তারা সন্তুষ্ট হবে কিনা সেটা তাদের বিষয়। আমরা সকলেই বসে দেখেছি যে, এই আইনটা যে উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল সেটা যাতে পূরণ করা যায় সেটার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেয়া।
তবে সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে সম্পাদক পরিষদ আগস্টেই একটি বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, ‘সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যেই আইনটি করার ঘোষণা দিয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের উদ্বেগ আমলে নেয়নি। সেই আইন সংশোধন, বাতিল বা নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও তাদের মতামত নেওয়া হবে সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেরকম কিছু না করেই সরকার প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি এবং তা আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ জনমনে প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক’।
সম্পাদক পরিষদ বলে, ‘সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের শাস্তি কারাদণ্ডের বদলে ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধানের কথা বলা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর অধীনে মানহানির দায়ে যে শাস্তির বিধান আছে, সেটা সংশোধন না করা হলে নতুন বিধান অকার্যকর হতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত ২৫ লাখ টাকা জরিমানা শোধ না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত কারাদণ্ডই ভোগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যে অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে বিধিবিধান আছে তার পরিবর্তে এসব শাস্তির বিধানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ধারা দুটি বাতিলের পক্ষে জোরালো দাবি উঠেছে। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে’।
অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনে কোনো বদল না আসার ব্যাপারেও উদ্বেগের কথা তুলে ধরে সম্পাদক পরিষদ। তারা বলে, ‘উদ্বেগের বিষয় হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাটি রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ধারার মাধ্যমে শাস্তির মাত্রা কিছু কমানো হলেও ঔপনিবেশিক আমলের ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষকে সন্দেহ করত বলে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন জারি করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন থাকার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না’।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অগ্রহণযোগ্য ধারাগুলো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও থেকে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ জানিয়ে তারা বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা ধারা অনুযায়ী, পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এই ধরা বলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত ”বিচারিক ক্ষমতা” দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারাটিও যেহেতু বহাল থাকছে তাই নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না’।
তারা বলে, ‘ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেহেতু সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু এই আইনে করা মামলাগুলোও প্রত্যাহার এবং এই আইনে যারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কারাভোগ করেছেন, তাদের মুক্তি দেওয়া হোক’।
Discussion about this post