আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া যখন চলমান অবস্থায় ইসরায়েলে হামাসের হামলার হামলার ঘটনা ঘটলো। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইসরায়েল ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’চুক্তির মাধ্যমে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডসকে বিশ্বাসঘাতকতার জলন্ত উদাহারণ বলে মনে করে। ২০২০ সালে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো বিতর্কিত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের সদস্যরা প্যারাগ্লাইডার ব্যবহার করে ভূমি, সমুদ্র ও আকাশপথে ইসরায়েলে প্রবেশ করে। গাজা উপত্যকা থেকে শত শত রকেট ছোঁড়া হয় ইসরায়েল ভূখণ্ডে।
ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গাজার জনজীবন। বিশ্বজুড়ে আলোচনা, সমালোচনা প্রতিবাদ চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, ইসরায়েল-হামাসের এই যুদ্ধে আরব দেশগুলোর অবস্থান কী? ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে এখন পযর্ন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কী বলেছে?
সৌদি আরব
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে, তারা ’ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে দখলদার ইসরায়েলি সেনাদের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে’। এবং ’উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা অবিলম্বে বন্ধ করতে এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে আহ্বান জানিয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি সেনাদের দখলদারিত্ব, অধিকার অস্বীকার এবং পবিত্র স্থানগুলো নিয়ে ইচ্ছাকৃত উষ্কানির কারণে সহিংসতা বাড়বে বলে র্পূবে সতর্ক করেছিল সৌদি আরব।
তাছাড়া বিবৃতিতে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করতে ’আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব পালন এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত সমাধানে একসাথে কাজ করার আহ্বান করা হয়েছে। সেই সাথে এই চলমান যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার কথাও বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।’
কাতার
কাতার সব সময় ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের কঠোর বিরোধিতা করে এসেছে। গাজা উপত্যকার সহিংসতা নিয়ে “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করেছে দেশটি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে কাতার বলে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার বারবার লংঘন করে বর্তমান উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
বিবৃতিতে বৈশ্বিক সিদ্ধান্তগুলো অনুসরণ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে গাজায় একতরফা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে ইসরায়েলকে বিরত রাখতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, ’কাতার ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারগুলো দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে, যার মধ্যে রয়েছে তাদের নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার। যার ভিত্তি ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক সীমারেখা মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং পূর্ব জেরুজালেমকে এর রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।’
সংযুক্ত আরব আমিরাত
সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েল-হামাস সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ বন্ধের আহবান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে চলমান যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি ও সমবেদনা জানানো হয়।
এতে আরব-ইসরায়েল মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃত উদ্যোগ ‘মিডলইস্ট কোয়ার্টেট’(যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ) দ্রুত সক্রিয় করার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতা, উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতা নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি।
গত ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় সংযুক্ত আরব আমিরাত হামাসের হামলাকে “গুরুতর এবং উল্লেখযোগ্য সহিংসতা বৃদ্ধির” কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়ে আরো একটি বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের জিম্মি করার খবরে তারা বিস্মিত। তবে গাজায় ইসরায়েলের হামলার সমালোচনা তারা এড়িয়ে গেছে। শেষে জোর দিয়ে বলেছে, উভয় পক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত রাখা উচিত এবং তাদের কখনওই সংঘাতের লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়।
বাহরাইন
ইসরায়লে হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়ে বাহরাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত সোমবার (৯ অক্টোবর) একটি বিবৃতি দেয়। এতে মধ্যপ্রাচ্যে সাহংসতা বৃদ্ধি এবং বেসামরিক মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলার জন্য হামাসকে দায়ী করা হয়।
এ ছাড়া বিবৃতিতে সাধারণ ইসরায়েলিদের জিম্মি করে অপহরণের জন্য হামাসের নিন্দা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এই চলমান সহিংসতা বন্ধের আহবানও জানানো হয়।
কুয়েত
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কুয়েত এবং সেইসাথে ইসরায়েলকে এই চলমান যুদ্ধের মূল হোতা হিসেবে দায়ী করেছে।
কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে “ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর উষ্কানিমূলক কার্যক্রম” এবং “তাদের বসতি সম্প্রসারণের নীতি” বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি হস্তক্ষেপ আহ্বান করেছে।
ওমান
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার এক রির্পোটে বলা হয়েছে, ওমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সর্বোচ্চ আত্মসংযম অনুশীলন করার আহ্বান জানিয়েছে।
বিবৃতিতে বৈশ্বিক সম্প্রদায় ও সংস্থাগুলোকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার এবং চলমান উত্তেজনা অবসানে আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহার করারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মিশর
১৯৮০ সালের শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রথম সফল দেশ মিশর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে মিশরের বার্তা সংস্থার রির্পোটে বলা হয়, যদি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে, তবে এই অঞ্চলকে (মধ্যপ্রাচ্য) তা ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
গত শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) থেকেই মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেপ বোরেলের সাথে আলাপ করছেন। তিনি বলেন, বড় ঝুঁকি এড়াতে উভয় পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে।
মরক্কো
গাজা উপত্যকায় পরিস্থিতির অবনতি এবং সেখানে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর তৎপরতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মরক্কো। চলমান সহিংসতায় দুই দেশের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বেপোরোয়া হামলার প্রতিবাদও করা হয়েছে।
মরক্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এসব কথা জানানো হয়।
লেবাননের হিজবুল্লাহ
এক বিবৃতিতে ইসরাইলে হামাসের হামলাকে “বীরত্বপূর্ণ ও দুঃসাহসিক অভিযান” বলে প্রশংসা করেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ।
হামাস ও তার সামরিক শাখা, ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের “উল্লেখযোগ্য এবং সাহসী অভিযানের” প্রশংসা করে লেবাননের সংগঠনটি। তারা বলে, ’আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাহসী ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক অভিযানকে সাধুবাদ জানাই।’
হিজবুল্লাহর নেতারা আরো বলেন, তারা মধ্যপ্রাচ্যর কোথায় কী ঘটছে তার ওপর গভীর নজর রাখছেন এবং তারা দেশে ও দেশের বাইরে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন।
হিজবুল্লাহ নেতাদের ভাষ্যমতে, ইসরায়েলের হামাসে এই অভিযান ছিল দখলদার বাহিনীর সংঘটিত চলমান অপরাধ এবং ফিলিস্তিনিদের পবিত্র স্থানগুলোতে তাদের ক্রমাগত দখলদারিত্বের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া।
ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীটি আরো জানায়, হামাসের অভিযানটি বিশ্বব্যাপী আরব ও মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বার্তা হিসাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে যারা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে।
সিরিয়া
সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে হামাসের এই অভিযানকে “প্রশংসনীয় সাফল্য” হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার সুরক্ষিত করার একমাত্র পথই হল প্রতিরোধের মাধ্যমে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে যাওয়া।
সিরিয়া ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমবেদনা এবং “জায়নবাদী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোর” সাথেও সংহতি প্রকাশ করেছে।
ইয়েমেন
ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা হামাসের এই অভিযানকে “বীরত্বপূর্ণ জিহাদি অভিযান” বলে অভিহিত করেছে।
বিদ্রোহী সংগঠনটি তাদের SABA নিউজ এজেন্সির ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে হামাসের এই হামলায় ইসরায়েলের “দুর্বলতা, ভঙ্গুরতা এবং শক্তিহীনতা” প্রকাশ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের এই অভিযানকে “মর্যাদা, গর্ব ও প্রতিরক্ষার যুদ্ধ” বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
সূত্র: দি নিউ আরব
Discussion about this post