মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র এবং পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
আদালতের পক্ষ থেকে এ রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট থেকে আদিলুর ও এলানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়। রাতেই অ্যামনেস্টিসহ আন্তর্জাতিক ৭২টি সংগঠন আদিলুরের কারাদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিবিসি, এএফপি, নিউইয়র্ক টাইমসের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এ দুজনকে কারাদণ্ড দেওয়ার সংবাদ প্রকাশ করে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক টুইটে জানায়, ‘ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নিপীড়নমূলক আইসিটি আইনের অধীনে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রধান আদিলুর রহমান খান ও এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে দুই বছরের কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছে। এক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালিয়ে এবং অভিযুক্ত করার পর তাদের এই সাজা দেয়া হলো’।
এতে বলা হয়, ‘২০১৩ সালে একটি বিক্ষোভে রাষ্ট্র পরিচালিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নথিভুক্ত একটি তথ্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল। অধিকার ও তার প্রধানদের ওপর রাষ্ট্রের এ ধরনের দমন-নিপীড়ন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সত্য বলার অধিকারের ওপর হামলা।’
টুইটে আরো বলা হয়, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করাটা কোনো অপরাধ নয়। মি. খান ও মি. এলানকে অতিদ্রুত এবং শর্তহীন মুক্তি দেওয়ার জন্য আমরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আজকের রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং মনে করছে এটি মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের সক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে’।
তাদের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করি এবং মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করি’।
এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন নামে একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা এ দুই মানবাধিকারকর্মীর পাশে থাকার কথা জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক ৭২ সংগঠন আদিলুর ও নাসিরের মুক্তি দাবি করে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রবার্ট এফ কেনেডির ওয়েবসাইটে এই সম্মলিত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নথিভুক্ত করার জন্য প্রতিশোধ হিসেবে খান ও এলানকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। ৭২টি সংস্থা মনে করে, আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কাজ বন্ধ করা উচিত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সেক্রেটারি ও পরিচালক যথাক্রমে খান ও এলানের বিরুদ্ধে অবিরাম সম্মানহানিমূলক প্রচারণা চালিয়েছে। অধিকার বাংলাদেশে একটি আন্দোলনের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত করে। প্রতিবেদনটি ২০১৩ সালে প্রকাশের পর তাদের আটক করা হয়েছিল। সে সময় আদিলুর রহমান খানকে ৬২ এবং এলানকে ২৫ দিনের জন্য আটক রাখা হয়। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর, ২০১৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ‘ভুয়া, বিকৃত এবং মানহানিকর’ ছিল অভিযোগ তুলে তাদের ট্রাম্পড-আপ অভিযোগে বিচারিক হয়রানির সম্মুখীন করা হতে থাকে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ তাদের মামলার শুনানি ত্বরান্বিত করেছে। যার জন্য অধিকারের মতো মানবাধিকার সংস্থাকে দায়ী করেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সরকার প্রতিনিয়ত সংস্থাটিকে প্রকাশ্যে তিরষ্কার করতে থাকে, এমনকি অধিকারের ডকুমেন্টেশনের ওপর নির্ভর করার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২২-এর ‘কান্ট্রি রিপোর্ট অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস : বাংলাদেশ’-এর বিশ্বাসযোগ্যতার সমালোচনা করে ও প্রশ্ন তোলে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিবৃতির শেষে বলা হয়, আমরা খান ও এলানের সাথে দাঁড়িয়েছি এবং সরকারকে অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। কারণ তাদের শুধু মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য আটক করা হয়েছে।
বুধবার রাতে ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তাতে প্রস্তাবে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার-’এর প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার, আদিলুর রহমান খান ও এ এস এম নাসির উদ্দিনের মুক্তি এবং সংগঠনটির নিবন্ধন ফের চালু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো যেন অনুমোদিত বিদেশি অনুদান কাজে লাগাতে পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে অনুরোধ করা হয়।
বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে, এ মামলায় ২০১৩ সালের আগস্টে আদিলুর রহমান খানকে গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা ঢাকায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের কার্যালয় পরিদর্শন করেন। সেসময় তার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, কানাডাসহ আরো কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরাও ছিলেন।
একই সময়ে জাতিসংঘও এক বিবৃতিতে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। এ ছাড়া মামলা চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমা বিভিন্ন মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা আদালতে উপস্থিত হয়েছেন।
আদিলুর রহমান বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের মে মাস পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। মানবাধিকার রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে ফ্রাঙ্কো-জার্মান মানবাধিকার পুরস্কার পান তিনি।
এ ছাড়া ২০১৪ সালে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য মার্টিন এনালস অ্যাওয়ার্ড পান আদিলুর রহমান খান। তবে ২০২২ সালের জুনে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার নিবন্ধন নবায়নের আবেদন করলে তা নাকচ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। এর ফলে নিবন্ধন হারায় অধিকার সংস্থাটি।
এমন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। পরে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও অধিকারের নিবন্ধন বাতিলের সমালোচনা করে।
২০১৩ সালের ৫ মে রাতে মাসে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায়। সেই সহিংসতায় ৬১ জন নিহত হয় বলে তথ্য প্রকাশ করে অধিকার। যাকে ‘মিথ্যা’ অ্যাখ্যা দিয়ে ওই বছরের ১০ অগাস্ট গ্রেপ্তার করা হয় আদিলুরকে।
তখন থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদিলুর রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। কারণ ওই রাতের অভিযান সম্পর্কে অধিকার প্রতিবেদন তৈরি করেছে যেখানে ৬১ জন নিহত হয়েছে বলে বলা হয়েছে, কিন্তু তাদের নাম-ঠিকানা সংস্থাটি জানাতে পারেনি।
বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় ওই তালিকার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চেয়ে চিঠি পাঠালেও অধিকার সে সময় বলেছিল, ওই ঘটনার তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করলে তারা সেখানে তালিকা দেবে।
এ ঘটনায় আদিলুর রহমান খানকে গ্রেপ্তারের পর কার্যালয়ে তল্লাশি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখন অধিকারের কর্মকর্তারা বলেন, হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংঘর্ষের সময় নিহত হয়েছে বলে যে ৬১ জনের তালিকা তারা তৈরি করেছেন, তাদের নাম-ঠিকানা সরকারের কাছে দেওয়া না হলেও বাংলাদেশের কিংবা আন্তজার্তিক কোনো মানবাধিকার সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়ার বিষয়টি তারা বিবেচনা করছেন।
তবে এ বিষয়ে আর অগ্রগতি হয়নি। সেই সময় অধিকারের তালিকায় নাম রয়েছে এমন কেউ কেউ বেঁচে আছেন বলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। হেফাজতে ইসলামের তখনকার নেতাদের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে জোরালো ভূমিকা দেখা যায়নি।
তবে কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী এক বিবৃতিতে বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতের কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার মিথ্যা তথ্য দেয়নি। অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসির উদ্দিন (এলান) রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন।
একই দিনে পৃথক দুটি বিবৃতি দেন ৪৮ নাগরিক এবং ৩৯ প্রবাসী। তারা আদালতের রায়ের সমালোচনা করে আদিলুর ও নাসিরের মুক্তি দাবি করেন।
যদিও শুক্রবারের শান্তি সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, আদিলুর রহমান টাকা খেয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশিদের বিভ্রান্ত করেছেন।
Discussion about this post