সরকারের তিন মেয়াদে গত ১৪ বছরে ৮২টি বেসরকারি/ আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) এবং ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ মোট এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে মার্কিন ডলারের মাধ্যমে। এ বাবদ এখনও বকেয়া আছে আনুমানিক সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।
ক্যাপাসিটি চার্জ কী? বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি সরকারকে দিতে হয়, সেটাকেই ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়।
যেহেতু বিদ্যুৎ বিক্রি করেই কেন্দ্রগুলো লাভ করে, তাই উৎপাদন বন্ধ রাখলেও তাদের একটি চার্জ (টাকা) পিডিবিকে দিতে হয়, যা চুক্তির সময় নির্ধারণ করা থাকে। বসিয়ে রেখে দেওয়া এই অর্থই ক্যাপাসিটি চার্জ।
ক্যাপাসিটি চার্জের মডেল ও এ সংক্রান্ত দায়মুক্তি আইনসহ বেশ কিছু কারণে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। এর ফলে দেশের ওপর বড় মাপের ভর্তুকির বোঝা তৈরি হচ্ছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে জ্বালানি সংকটে প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে, অন্যদিকে বন্ধ থাকার পরও গুনতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। ক্যাপাসিটি চার্জকে ‘লুটেরা মডেল’ উল্লেখ করে আইএমইডির এ প্রতিবেদনে খাতটির সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আইএমইডি আরো বলছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে চীন ও ভারতীয় সরবরাহকারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর মহাজোট সরকার প্রাইভেট সেক্টরের সহযোগিতায় ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলনির্ভর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ নিয়েছিল। প্রাইভেট সেক্টরের ৫৮টি ফার্মকে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত নানা উৎপাদন ক্ষমতার রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সরাসরি লাইসেন্স দেওয়া হয় জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। কোনো স্বীকৃত টেন্ডার-প্রক্রিয়া ছাড়াই এসব ফার্মকে বাছাই করা হয়েছিল জরুরি চাহিদা মোকাবিলার কথা বলে। আদালতে মামলা করে যাতে ওই বাছাই প্রক্রিয়াকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে, সে জন্য সরকার ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে দায়মুক্তির ব্যবস্থা করে। এসব ফার্ম নির্বাচনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মহোৎসব চালানো হয়েছিল বলে ব্যাপকভাবে অভিযোগ উঠেছে। এ আইনের বলে বিদ্যুৎ খাতের ইউনিটপ্রতি ক্রয়মূল্য ও খরচের মডেল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। এর বিরুদ্ধে কোনো আইনি প্রতিকার পাওয়ার উপায় নেই। এই ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ এখনো চালু রয়েছে।
২০০৯ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি খরচ ধরা হয়েছিল ১৬-২০ টাকা এবং তখন কয়লা ও এলএনজির আর্ন্তজার্তিক বাজার দর অনেক কম ছিল।
কিন্তু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ক্রয় না করলে ওগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দেওয়ার ব্যবস্থাটা কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারের জন্য বড়সড় বোঝায় পরিণত হয়, অনেকগুলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের সঙ্গে সরকারের চুক্তি বাতিলের সময় হলেও লবিং করে ওই সব প্ল্যান্টের মালিকেরা তাদের চুক্তি নবায়ন করিয়ে নিয়েছেন।
এর মধ্যে সরকার বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণসহ মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ রূপপুর প্ল্যান্ট ২০২৪ সালে উৎপাদনে গেলে সেটি ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে বলে সরকার দাবি করে চলেছে।
এখন দেশের বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শীতকালে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটে এবং গ্রীষ্মকালে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াটে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি ও তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের এলএনজি ও তেল আমদানির সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো ২০২২ সালের জুলাই থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফার্নেস অয়েলচালিত প্ল্যান্টগুলোতেও উৎপাদন-সংকোচনের নীতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একই সঙ্গে এলএনজিচালিত কয়েকটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টও পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না আমদানির সক্ষমতা না থাকায়। প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি করতে না পারায় ইতিমধ্যে উৎপাদনে এসে যাওয়া সত্ত্বেও পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট ঠিকমতো চালু করা যাচ্ছে না। এসব এলএনজি এবং কয়লাচালিত প্ল্যান্টকেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে পিডিবিকে।
বিভিন্ন পত্রিকার নিউজ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ অব্যবহৃত থাকবে। এই নিউজ আইটেমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ বাদেই বিদ্যুতের ইনস্টল্ড ক্যাপাসিটি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ২৬৩ মেগাওয়াট। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হবে আরও অন্তত সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট, ফলে ওই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়াবে ৩৮ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। অথচ ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে গড়ে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এই চাহিদা যদি আগামী দুই বছরে গড়ে প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বেড়েও যায়, তারপরও ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত থেকে যাবে। ফলে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে যে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দিতে হবে তার বোঝা বহন করা পিডিবির জন্য ‘মারাত্মক বিপজ্জনক’ হয়ে উঠবে। এটি কমাতে হলে যে প্লান্টগুলো বছরের পর বছর বসে থাকছে সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। কিন্তু সরকার এগুলো চালু রাখছে, কারণ তারা দেখাতে চায় যে তাদের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
রামপালের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, বাঁশখালীর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিক গ্রুপের ৬০০ মেগাওয়াট, ভারতের রিলায়েন্সের ৭৫০ মেগাওয়াট, মহেশখালীর মাতারবাড়ীর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং সর্বোপরি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে। চাহিদা ও সরবরাহের এত বড় ‘ভুল প্রাক্কলন’ কাদের স্বার্থে করা হয়েছে? যারা করেছে তারা দেশকে একটি মহাবিপদে ঠেলে দিয়েছে।
পিডিবির এক তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সংস্থাটির ব্যয় ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এক বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি প্ল্যান্ট (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৭ শতাংশ বেশি।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা এক দশকে অনেকটাই বেড়েছে। এ সময় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিদ্যুৎ খাত। উল্টো বড় আকারের অনেকগুলো ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারের (আইপিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ খাত গুটিকয়েক বড় করপোরেটের দখলে চলে গেছে। আর এক দশকে শীর্ষ ১২টি গ্রুপ/কোম্পানির পকেটে গেছে ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ৬৮ শতাংশ। দেশের বাজেটের মোট বার্ষিক ভর্তুকি বরাদ্দের ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় হয়। সিপিডির ধারণা, এই বরাদ্দের বেশিরভাগই পরিশোধ করা হয় ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে।
অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান, চাহিদা ও যোগানের বিবেচনায় এত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এখন এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ আছে, দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আপৎকালীন অর্থাৎ ২-৩ বছরের জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুমোদন দেওয়া হলেও দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়িয়ে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ না নিয়েও বিপুল অঙ্কের টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে এবং এখনো দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এ বিশাল অঙ্কের টাকা গুটিকয় মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার কোনো সরকার রাখে কি না। কেননা, এতকিছুর পরও দেশে বিদ্যুৎ সংকট কাটেনি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি নয়; এর বিপরীতে ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। এ খাতে অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণে ইতিমধ্যেই রাষ্ট্র বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। মানুষ এ বোঝা আর কতদিন বহন করবে?
Discussion about this post