সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন ছবি বিকৃত করে তা প্রচারের ঘটনা অনেক বেড়েছে। একই সময়ে সংবাদমাধ্যমেও বেড়েছে প্রোপাগান্ডা। যা বিশেষ ভাবে দেখা গেছে চিকিৎসা নিতে বিএনপির কয়েকজন নেতার সিঙ্গাপুর যাওয়ার ঘটনায়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের)-কেউ বাদ যাচ্ছেন না বিকৃত ছবি, ভিডিও তৈরি করে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কূটকৌশল থেকে। জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, বিরোধী রাজনীতিকদের মনোবলে চিড় ধরানো, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিকৃত ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে প্রচার চালানো বা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়ে থাকে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
অনেকে বলছেন, বিএনপি তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন কয়েকবার তুঙ্গে তুলে আবার স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশেষত আগস্টজুড়ে তাদের জোরদার কর্মসূচি ছিল না। তাদের নীরবতার সুযোগ নিয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কৌশল নিয়েছে সরকার পক্ষ। যা অন্তত গত এক সপ্তাহে বেড়েছে।
এর শুরুটা হয়েছিল বিএনপি সহাসচিবকে দিয়ে। গত ২৪ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। তার সঙ্গে তখন ছিলেন তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম। ২৭ আগস্ট ফেসবুকে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যাচ্ছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকার চেক ইস্যু করা হয়েছে। মির্জা ফখরুল ও তার স্ত্রীর ছবি দিয়ে দাবি করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে বিদেশে গেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ওই দিন রাতেই এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মির্জা ফখরুলের মতামত জানতে চায়। তিনি সরাসরি বলেন, ‘এটি আওয়ামী লীগের একটি পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা। আমরা আন্দোলন করছি। সরকার নিপীড়ন-নির্যাতন করে এই আন্দোলন কোনোভাবেই দমন করতে পারছে না। দেশের মানুষ এই আন্দোলনে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন। তাই সরকার নানা প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে’।
তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকে বিপথগামী করার জন্য, বিভ্রান্ত করার জন্য, নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এই কাজটি তারা করছে। তারা খুব পরিকল্পিতভাবেই এই কাজগুলো করে, সেটাই করছে। তাদের কাজই গুজব তৈরি করা, তাদের কাজই মানুষের চরিত্র হনন করা’।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি এমন একটি জায়গায় চলে গেছে, এটাকে আমরা বলি নষ্ট সময়, নষ্ট রাজনীতি। কত টাকা আছে তাদের? লক্ষ-কোটি টাকার মালিক হয়েছে জনগণের সম্পদ-ব্যাংক লুট করে। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে যে মির্জা ফখরুলকে কেনা যায় না। মির্জা ফখরুল বিক্রি হয় না। তারা সবাইকে নিজেদের মতো বিক্রয়যোগ্য পণ্য মনে করে। মির্জা ফখরুলরা টাকার জন্য রাজনীতি করেন না, তাদের কেনা যায় না।’
ওইদিন রাতেই তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ‘রিউমার স্ক্যানার’ তাদের ফেসবুক পেজে লিখেছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে মির্জা ফখরুলের বিদেশ ভ্রমণ দাবিতে ভাইরাল চেকটি ভুয়া।’ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নাম ও নম্বরের মিল না থাকাসহ একাধিক কারণ দেখিয়ে চেকটিকে ‘ভুয়া’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ফ্যাক্ট চেক জানায়, ওই চেকের গায়ে লেখা রাউটিং নাম্বার এবং অ্যাকাউন্ট নম্বর দু জায়গায় দু রকম লেখা আছে। যা কোনোভাবে চেকে থাকার কথা না।
এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের তেজগাঁও শাখা বলে কোনো শাখা নেই। আছে তেজগাঁও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্রাঞ্চ। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ফান্ড বলেও কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। ওই তহবিলের নাম প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল।
তারা জানায়, চেকটি ছিল আইনজীবী প্রণোদনা তহবিল থেকে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতিকে দেয়া একটি অর্থসহায়তার চেক। চেকের গায়ে থাকা অ্যাকাউন্ট নম্বর রাউটিং নম্বর ইত্যাদির সাথে ভাইরাল চেকের নম্বরগুলো মিলে যায়।
একই সপ্তাহে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুরক্ষা বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে, বিশ্বের ১৬০ বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি সম্বোধন করা চিঠিতে সই করা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন; নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, রাজনীতিক, কূটনৈতিক, নির্বাচিত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতারা।
এরপর ড. ইউনূসকে নিয়েও বিভিন্ন বিকৃত ছবি প্রচার করা হয় সামাজিক মাধ্যমে।
রিউমার স্ক্যানার জানায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং এক নারীর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। ছবিতে তাদের দুজনকে একটি বই নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। যেখানে বইটির মলাটে এক নারীর বিকিনি পরিহিত ছবি রয়েছে।
৩১ আগস্ট ওই ছবি এবং ড. ইউনূসকে জড়িয়ে একটি প্রোপাগান্ডা ভিডিও ‘ভয়েজ অব বাংলা’ নামের ফেসবুক পেজে দেওয়া হয়।
রিউমার স্ক্যানার জানায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক নারীসহ এক বিকিনি পরিহিত নারীর দৃশ্যযুক্ত মলাটের বই দেখার দাবিতে প্রচারিত এই ছবিটি এডিটেড। প্রকৃতপক্ষে, এক নারীর হাতে থাকা একটি বই নিয়ে আলোচনা কালে ধারণ করা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি ছবিকে ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করে বইটির মলাটে বিকিনি পরিহিত এক নারীর ছবি যুক্ত করা হয়েছে।
তারা জানায়, অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতির মাধ্যমে ফটো শেয়ারিং ওয়েবসাইট গেটি ইমেজে মূল ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। ওই ছবির বিবরণে লেখা হয়, ছবির বর্ণনায় লেখা হয়, ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৬ জয়ী বাংলাদেশী ব্যাংকার এবং অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস (বাম) ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ক্রিসিয়েন্ডো বিয়েন (গ্রোয়িং আপ ওয়েল) এর পরিচালক গুয়াতেমালান এডনা ডে মোরালেসের সাথে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ শীর্ষক তার একটি বই নিয়ে গুয়াতেমালা সিটিতে আলোচনা করছেন। ইউনূস বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের মানুষদের গ্যারান্টি ছাড়াই ঋণ দেওয়ার বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট অস্কার বার্গারের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।’
সোমবার (৩ সেপ্টেম্বর) নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন শিবিরের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে এমন একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। যার কোনো সত্যতা নেই বলে জানা গেছে। ছবিটি এডিটেড বলে খালি চোখেই ধরা পড়ে।
প্রোপাগান্ডা থেকে রেহাই পাননি জি এম কাদেরও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুঞ্জন ছড়ায়, বর্তমান ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিতে জাপার ওপর ভারতের চাপ রয়েছে। দলটি ভারতের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয়। তবে জি এম কাদের এসব গুজব নাকচ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি বিক্রি হওয়ার মতো মানুষ নই। ইউটিউবে কেউ একজন প্রচার করেছে আমি নাকি বিক্রি হয়ে গেছি। এই কথাটা আমাকে আহত করেছে। চাকরি জীবনে অনেক পাওনাও গ্রহণ করিনি নীতির প্রশ্নে। একবার মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছি, আরেকবার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিনি। টাকা বা ক্ষমতার জন্য বিক্রি হতে পারি না।’ (সমকাল)
এসময়ে প্রপাগান্ডায় অংশ নেয় প্রথম সারির বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকাও। তারা বিএনপির কয়েকজন নেতার একই সময়ে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা নিয়ে অনেকগুলো সংবাদ প্রকাশ করে গুরুত্ব সহকারে। যার সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘বিএনপি-জাপা বৈঠক সিঙ্গাপুরে’ শীর্ষক সংবাদের প্রতিবাদ জানান জাপা মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু।
এক প্রতিবাদলিপিতে তিনি বলেন, প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, থাই এয়ারওয়েজ-এর একটি উড়োজাহাজে থাইল্যান্ডে যাত্রা বিরতি করে সিঙ্গাপুর গেছেন জাতীয় পার্টি মহাসচিব।
প্রকৃতপক্ষে, থাই এয়ার ওয়েজ নয়, বাংলাদেশ বিমানে সস্ত্রীক থাইল্যান্ড গেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব। থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যান জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
তার প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, গেল ৪-৫ বছরে সিঙ্গাপুর যাননি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু।
ওই সংবাদে বলা হয়, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম এমপিও জাতীয় পার্টি মহাসচিবের সঙ্গে ছিলেন। জাতীয় পার্টি জানায়, ফখরুল ইমাম তখন দেশেই ছিলেন। ফখরুল ইমামও বলেন, আমার জানা মতে মহাসচিবও চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড গিয়েছেন, সিঙ্গাপুর নয়।
একই সপ্তাহে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়ও শিকার হয়েছেন ডিপফেকের।
অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, গত জুলাইয়ের শেষে ‘শ্রীকান্ত’ নামের ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্যে সোহিনী সরকারের চেহারায় নিপুণ রায়কে বসানো একটি রিল ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ডিসমিসল্যাব ওই ভিডিও যাচাই করে বলেছে, এটি ডিপফেক।
একই ঘটনা ঘটেছে ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবালের ক্ষেত্রে। চলতি আগস্ট মাসের শুরুতে তাকে ছাত্রদলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপরই তার একটি ছবি নিয়ে এআই টুল ব্যবহার করে ভিডিও বানানো হয়। ডিসমিসল্যাব যাচাই করে জানিয়েছে, এটিও ডিপফেক। এ ছাড়া ফেসবুক কর্তৃপক্ষও এটি ভুয়া বলে ভিডিওটির ওপর বার্তা দিয়ে রেখেছে।
ডিসমিসল্যাবের হিসাবে গত জুলাই থেকে আগস্টের ২০ তারিখ পর্যন্ত যত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে, তার ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশই হচ্ছে রাজনীতিবিষয়ক।
এই সময়ে ছড়ানো মিথ্যা বা অপতথ্যের মধ্যে ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ স্থানীয়, এর মধ্যে ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ রাজনৈতিক।
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আগস্ট মাসজুড়ে বড় কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। রাজপথে উত্তেজনা না থাকায় প্রোপাগান্ডা ডালপালা মেলেছে অনলাইন ও অফলাইন মাধ্যমে। নির্বাচন সামনে রেখে তা আরো বাড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
Discussion about this post