ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন, মাস দুই আগে (২৩ জুন) নামটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসে । তখন প্রিগোঝিনের ওয়াগনার বাহিনী পুতিনের দুর্গ মস্কোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। দিন দুই আগে (২৩ অগাস্ট) মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাত্রাপথে এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রিগোঝিনের মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হয়।
রাশিয়ার বেসরকারি সেনাবাহিনী ওয়াগনারের প্রধান ছিলেন ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন। টাকার বিনিময়ে যুদ্ধ করতো তার বাহিনী। রুশ সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঠিক মাস দুয়েকের মাথায় প্রিগোঝিনের মৃত্যুকে অনেকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছেন না। তার মৃত্যু ঘিরে চলছে নানান জল্পনা-কল্পনা।
সিআইএ’র সাবেক এক কর্মকর্তা ড্যানিয়েল হফম্যান দাবি করেছেন, পুতিনের নির্দেশেই প্রিগোঝিনকে খুন করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ সম্পর্কে ঈঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি না আসলে কী ঘটেছে। তবে আমি বিস্মিত নই’।
পুতিনের প্রতিশোধ পরায়ণতা এবং তার সমালোচকদের রহস্যজনক মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সিআইএ’র পরিচালক বিল বার্নস এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। এসব মন্তব্য অবশ্য পুতিন থোড়াই আমলে নেন। যদিও শেষে সকল বিতর্কের মঝে তিনি প্রিগোঝিনের মৃত্যুতে সমবেদনা জানিয়েছেন।
পুতিনের সাথে প্রিগোঝিনের সখ্য গড়ে ওঠে নব্বই দশকের গোড়ায়। দু’জনের মধ্যে পরিচয় হয়েছিলো একটি খাবার দোকানে। প্রিগোঝিন তখন চুরির দায়ে বারো বছর জেল খেটে বেরিয়েছেন। মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে খুলেছেন ফাস্টফুডের দোকান। চুরির দায়ে এর আগেও আড়াই বছর জেল হয়েছিলো প্রিগোঝিনের।
সোভিয়েত ভাঙনের পর পুতিন গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি থেকে রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিনে বদলি হয়ে আসেন। পুতিনের সাথে পরিচয়ে সূত্রে প্রিগোঝিনের ভাগ্য খুলে যায়। ক্রেমলিনের সাথে ভালো সম্পর্কের কারণে প্রিগোঝিন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী থেকে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী সরকারি ঠিকাদার।
ক্রেমলিনের খাবার সরবরাহের কারণে প্রিগোঝিন পুতিনের ব্যক্তিগত ‘রাঁধুনি’ হিসেবে পরিচিতি পান। পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও দু’জনের সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। এ সুযোগ কাজে লগিয়ে প্রিগোঝিনও নিজেকে সফল ব্যবসয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন রাশিয়ার অলিগার্কদের একজন।
জুন মাসের বিদ্রোহের আগে পর্যন্ত প্রিগোঝিন ছিলেন পুতিনের বিশ্বস্ত সহযোগী। এ বিদ্রোহকে পুতিন ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ এবং ‘পিঠে ছুরিকাঘাত’ বলেছিলেন। রাশিয়ার পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সেদিনই প্রিগোঝিনের মৃত্যু পরওয়ানা জারি হয়ে গিয়েছিলো।
বিদ্রোহের মাস দুই আগে রাশান ব্লগার সেমিয়ন পেগভকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রিগোঝিন বলেছিলেন, অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঘাটতির কারণে আমাদের অনেক বেশিসংখ্যক সেনা মারা যাচ্ছে। এক চিঠিতে তিনি রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে যত দ্রুত সম্ভব গোলাবারুদ পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন।
রাশান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে ইউক্রেনে প্রিগোঝিনের ওয়াগনার বাহিনীর প্রায় পঞ্চাশ হাজার সক্রিয় সেনা সদস্য রয়েছে। ওয়াগনার বাহিনী ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে বাখমুত থেকে সরিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলো। যদিও রাশিয়ার সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহে ঘাটতির অভিযোগ ছিলো তার।
সে অভিযোগের জের ধরে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক-প্রধানের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন প্রিগোঝিন। শেষে বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় এ বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
বিদ্রোহের অবসানের দু’মাস পরই প্রিগোঝিনের রহস্যজনক মৃত্যু হলো।
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ওয়াগনার বাহিনীর টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোনের তরফ থেকে দাবি করা হয়, রুশ প্রতিরক্ষা বাহিনী মস্কোর উত্তরে তেভের অঞ্চলে প্রিগোঝিনের ব্যক্তিগত বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
প্রিগোঝিনের মুত্যুর পর ওয়াগনার বাহিনীর অবস্থান কী হবে, তা নিশ্চিত নয়। যদিও এ বাহিনীর জন্ম হয়েছিলো সরাসরি পাপা’র নির্দেশে। হয়তো পাপাই নিধার্রণ করবেন ওয়াগনার বাহিনীর ভবিষ্যৎ। পুতিনের ডাকনাম পাপা ।
২০১৪ সালে গঠিত এ বাহিনীর প্রকাশ্য নেতৃত্বে ছিলেন চেচনিয়ায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা কর্মকর্তা দিমিত্রি উৎকিন। প্রকাশ্য নেতৃত্বে প্রিগোঝিনের আবির্ভাব ঘটে আরও পরে। যদিও সবসময় এর প্রধান হিসেবে সক্রিয় ছিলেন প্রিগোঝিন।
বছরের পর বছর ধরে গোপনে কর্মরত পুতিনের কমান্ডারদের সর্বাধিক আলোচিত সদস্য প্রিগোঝিনের সাফল্য থ্রিলার ফিল্মকেও হার মানায়। বস হিসেবেই খ্যাত ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন। রাশিয়ায় তার ভক্তকূলের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলে সালে ওয়াগনার বাহিনীর সদস্যরা রাশিয়াকে সহায়তা করে।
২০১৫ সালে সিরিয়ার সরকার সমর্থক বাহিনীর পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করে ওয়াগনার বাহিনী। ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপে প্রিগোঝিন এবং তার বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধে শুরুর আগে পুতিন প্রিগোঝিন সম্পর্কে আসল তথ্য প্রকাশ করেননি। অস্ট্রিয়ান টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে পুতিনকে প্রিগোঝিন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “সে একটা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালায়, এটাই তার কাজ; সে সেন্ট পিটার্সবার্গের এক রেস্তোরাঁর মালিক।”
২০২০ সালে অফ্রিকায় ওয়াগনার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এ গ্রুপটির ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থলের বেরিয়ে আসে। পুতিন প্রিগোঝিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে লুকোচুরি খেলা বন্ধ করেন।
প্রিগোঝিনকে পুতিন ব্যবসায়ী ও মানবহিতৈষী জর্জ সোরোসের সাথে তুলনা করেন। ২০২২ সালে প্রিগোঝিন রাশিয়ান ফেডারেশনের হিরো উপাধিতে ভূষিত হন। গত সেপ্টেম্বরে প্রিগোঝিন গর্বভরে ঘোষণা করেন, ২০১৪ সালে তিনিই গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ওয়াগনার গ্রুপে সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দী থেকে ভাড়াটে খুনিদের নেয়া হতো। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাও ওয়াগনার গ্রুপে কাজ করতেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশ এই গ্রুপকে সক্রিয় অপরাধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনকে যদি আমরা একজন অপরাধমনস্ক উচ্চাভিলাষি বলি তাহলে ভ্লাদিমির পুতিনকে নিশ্চয়ই তার স্রষ্টার কৃতিত্ব দিতে হবে। আর যদি প্রিগোঝিনকে বিশ্বাসঘাতক বিদ্রোহী বলি তাহলে পুতিনকে শত্রু দমনের নিপুন কারিগরের তালিকা থেকে আপাতত বাদ রাখতে পারবো না। সে ইতিহাস তার রয়েছে।
আরশাদ সিদ্দিকী : সাংবাদিক, গবেষক
Discussion about this post