অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কোনো ভালো খবর মিলছে না। দীর্ঘ সময় ধরে চলা বহুমুখী অর্থনৈতিক সংকট দেশবাসীকে কাবু করে ফেলেছে। যে ডলার-সংকট নিয়ে অর্থনীতির খারাপ অবস্থা শুরু হলো, সেই সংকট এখনও কাটেনি; বরং ডলার-সংকটের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন খাতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজি। এতে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। মন্দায় বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে; মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। এসবের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছরে বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আকস্মিক ধাক্কা সামলানোর জন্য যে দৃঢ়তা থাকতে হয়, ম্যাক্রোইকোনমিক কাঠামোতে সেই দৃঢ়তা আর অবশিষ্ট নেই। সুতরাং ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের প্রতিকূলতা সহজেই অর্থনীতির কবজি সজোরে মুচড়ে দিতে সক্ষম হবে।
মূল্যস্ফীতি, প্রবাসী আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খেলাপি ঋণ, রপ্তানি, রাজস্ব কোনো সূচকের অবস্থাই সন্তোষজনক নয়। গত এক থেকে দেড় বছরে প্রায় প্রতিটি সূচকের শক্তিশালী অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকের আরও অবনতি হয়েছে। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এখন হুমকির মুখে।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, সংকটগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং পর্যায়ক্রমে অপেক্ষাকৃত কঠিনভাবে আমাদের সামনে আসছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, খুব শিগগির এ সংকট কাটবে না বরং আগামী বছরগুলোয় তা আরও তীব্র হবে। বলা যায়, এই সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য তেমন কোনো ভাল উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি। এবং এর ফলে প্রায় দেড় দশক ধরে চলে আসা স্বজনতোষী অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির ধারা থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। যে কারণে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো অর্থনীতির ‘অর্থ’ এবং ‘নীতি’ দুটোরই মূল্য কমেছে; বেড়েছে সংকট আর দুর্নীতি। তাই সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, অর্থনীতির নানামুখী সংকট একীভূত হয়ে ধীরে ধীরে বড় বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। সরকারের স্বজনতোষী নীতি, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করতে না পারলে নিকট ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি এক ভয়াবহ সংকটে পতিত হবে।
চলতি অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—এই তিন মাস জাতীয় নির্বাচনের সময়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। নির্বাচনের সময়ে এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ থাকে। দেখা দেয় নানা ধরনের অনিশ্চয়তা। সব মিলিয়ে অর্থনীতির বেসামাল অবস্থার দ্রুত উন্নতির আশা দেখছেন না অর্থনীতিবিদেরা।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এক বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির হিসাবে গত এক বছরে মানুষের খরচ ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কষ্ট বেশি বাড়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের ওপর আছে। গত এক যুগের মধ্যে এক প্রান্তিকে সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি—আর দেখা যায়নি। অর্থনীতির সংকট কাটাতে গত দুই বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি থেকে বাঁচতে আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়িয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল মুদ্রা সরবরাহ কমানো। বাংলাদেশ একই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে দেড় বছর পর। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও এখন অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেওয়া শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অনেক দেরিতে নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে সংকট কেটে যাবে—এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। গত এক বছর ধরেই মজুরি বৃদ্বির হার মুল্যস্ফীতির চেয়ে কম। মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে কাটছাঁট করতে হচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষদের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও বাংলাদেশ পারছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য চারটি কারণ দেখিয়েছে। যেমন: দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি; দুর্বল মুদ্রানীতি; টাকার অবমূল্যায়ন; সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের প্রতি মাসেই ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় কমেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ১০.২৭ শতাংশ এবং গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৬ শতাংশ কম। আগস্ট মাসে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১.৬০ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে আসে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার; যা গত ৪১ মাসের মধ্যে এক মাসে আসা সবচেয়ে কম প্রবাসী আয়। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ১.৯ বিলিয়ন ডলার এসেছিল। রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় ডলারের যোগানের বড় শক্তি হলো এই প্রবাসী আয়। কিন্তু যত লোক গত এক বছরে বিদেশে গেছে, সেই তুলনায় প্রবাসী আয় আসছে না। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১০ লাখ ৭৪ হাজার কর্মী বিভিন্ন দেশে গেছে; যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে ডলারের দামের পার্থক্য। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠালে ১ ডলারে ১১০-১১২ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু হুন্ডিতে প্রবাসী আয় পাঠালে ১১৮-১২০ টাকা পায় প্রবাসীরা। এ ছাড়া অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, নির্বাচনের বছরে টাকা পাচার বেড়ে যায়। টাকা পাচারে প্রবাসী আয়কে ব্যবহার করার অভিযোগ আছে। বিদেশ থেকে প্রবাসী কর্মীর কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করা হয়। আর দেশে ওই কর্মীর আত্মীয়স্বজনকে টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। ফলে দেশে ডলার আসছে না। এতে রিজার্ভও কমে যাচ্ছে।
এই অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও খুব বেশি সুখবর নেই। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—প্রতি মাসেই প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা আশা জাগাতে পারছে না। কারণ, শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানি পণ্যের মধ্যে তৈরী পোশাক ছাড়া অন্য চারটির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে। আবার মাসের হিসাবেও রপ্তানি আয়ের চিত্র ওঠানামা করছে। গত জুলাই মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ডলার। পরে তা বেড়ে যায় ৪৭৮ কোটি ডলারে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাসে তা আবার ৪৩১ কোটি ডলার হয়েছে। গত দেড় বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশের মতো। এর সুফল কিছুটা পাচ্ছে রপ্তানিকারকেরা।
অন্যদিকে সরকারের আমদানি সংকোচন নীতির কারণে বিপাকে পড়েছেন আমদানি পণ্যের ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যেই এ খাতের অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পর থেকে প্রায় ৬৬ শতাংশ মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং ৩০ শতাংশ শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা কমে গেছে, যা দেশের রপ্তানি খাতের ভবিষ্যৎকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিনিয়োগ প্রবাহেও কোনো ভালো খবর নেই। কারণ বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে নতুন ব্যবসা বা প্রকল্প শুরু কিংবা বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে না।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা)র তথ্যমতে, গত অর্থবছরের মে-জুলাই এই তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ প্রস্তাব কমেছে ৩৯ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন খাতে ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। এটি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য একটি নেতিবাচক দিক, কারণ বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। একইসঙ্গে এটি অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অভাবের একটি প্রতিফলন, যা চলতি অর্থবছরে সরকারের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হতে পারে।
গত এক দশকে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে হু হু করে। মেগা প্রকল্পের নামে মেগা লুট দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়েছে। সরকারের স্বজনতোষী নীতি এবং উন্নয়নের গণতন্ত্রের বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জনগণের ওপর তথা দেশের অর্থনীতির ঘাড়ে চাপানো হয়েছে অসহনীয় ঋণের বোঝা। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অর্থাৎ আগামী ৪ মাসে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ মুহূর্তে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমে আসা এবং সার্বিকভাবে ডলার সংকটের কারণে এ ঋণ পরিশোধ করা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। এর পাশাপাশি মুডিস এবং এসএন্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেওয়ায় নতুন করে ঋণ পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ছে। এদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধেও চাপ বাড়ছে। অথচ বিদেশি সহায়তা ছাড় কমেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই-আগস্ট মাসে বিদেশি ঋণ এসেছে ৭৪ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে ঋণ এসেছিল ৮৬ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের তিন মাসের হিসাব প্রকাশ করেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সম্পদ জোগানের চাপ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত—এসব সামলে এনবিআর কিছুতেই শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) চার হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় ঘাটতি হয়েছে।
গত এক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমদানি-রপ্তানির আয়-ব্যয় মেটানোর পর প্রতিমাসেই ১ বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ এভাবে কমতে থাকলে আগামী মাসগুলোতে রিজার্ভ কমার পরিমাণ আরও বাড়বে। দেশের অর্থনীতির জন্য যা অশনিসংকেত। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই রিজার্ভ কমেছে ৪৪৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। ৩ অক্টোবরের হিসাবে তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৭৪ কোটি ডলার। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৯০ কোটি ডলার। আর প্রকৃত রিজার্ভ আরও কম, ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। এই সময়টা ছিল ঋণখেলাপিদের জন্য স্বর্ণযুগ। গত ছয় মাসে খেলাপি ঋণ (জানুয়ারি থেকে জুন) বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। আর ১ বছরে (জুন-২২ থেকে জুন-২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি, সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
সরকারের সুবিধাভোগীরা বৈধ, অবৈধ নানা সুবিধা আদায় করতে গিয়ে দেশের প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। বিদেশে টাকা পাচার খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে ১ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে দেশ থেকে পাচারের অভিযোগ ওঠে। আদালত প্রথমে এ অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিলেও কোনো এক অজানা কারণে সেই তদন্তের ওপর ৩ মাসের স্থগিতাদেশ জারি করা হয়।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, আরেকটি ঘটনায় রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংক থেকে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো এক ‘বিশেষ বিবেচনায়’ সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ব্যবসায়ী গ্রুপকে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসি-ইউএনওদের জন্য কেনা হচ্ছে সচিব গ্রেডের গাড়ি। পত্রিকার পাতা ওলটালেই এ রকম আরও নানা ঘটনা প্রতিনিয়তই আমাদের চোখে পড়ে। বোঝা যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতির এ ভয়াবহ সংকটকালেও সরকার গত দেড় দশকে তৈরি করা ব্যবস্থার পথে হাঁটতেই স্বচ্ছন্দবোধ করছে, হয়তো সরকারের তৈরি করা সেই ব্যবস্থাই এখন সরকার তথা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, গত দেড় বছরে অর্থনীতি সামলাতে সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা ফল দেয়নি; বরং উল্টো হয়েছে। রিজার্ভ কমেছে, প্রবাসী আয় কমেছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আবার সামনে আছে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এতে অর্থনীতির সমস্যাগুলো আরও গভীর হবে। তখন শুধু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে দায় চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এখন থেকে সঠিক নীতি নির্ধারণ করতে হবে। নীতি-নির্ধারকের অর্থনীতিতে চলমান সমস্যাকে আগে প্রথমে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং নীতি-নির্ধারকেরা যদি আগে থেকেই সঠিকভাবে সমস্যা চিহ্নিত করতেন বা করতে পারতেন, তাহলে আশার আলো দেখা যেত এবং তখন হয়তো সঠিক উদ্যোগ নেওয়া হতো।
এই ক্ষত্রে, মুদ্রানীতির সংস্কার করতে হবে। সুদের হার বাড়ালে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা উচিত। গত তিন মাস টাকা ছাপানো বন্ধ আছে। টাকা ছাপানো বন্ধ রাখার উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। ৫০ শতাংশ এককালীন পরিশোধ করে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এ ধরনের অসৎ আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সার্বিকভাবে আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে।
পরিশেষে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা নির্ভর করে সে দেশের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর। একটি ভালো নির্বাচন হলে এবং তাতে একটি জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে হয়তো তা সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে। তখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। অনেক কিছুতে সাহস তৈরি হবে। এখন অর্থনীতিতে যে ভাটার টান চলছে, তার মধ্যে যদি আবার আগামী নির্বাচনটি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, একটি ভালো নির্বাচন না হয়; তাহলে দেশবাসীর ভোগান্তি বাড়বে। একটি ভালো নির্বাচন হলে দেশটা সম্পর্কে বিদেশিদের আগ্রহ তৈরি হবে। তারা সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে তা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করবে। আর যদি সেটি না হয়, তাহলে বিদেশিরা দেশটির প্রতি আগ্রহ দেখাবে না। আবার স্থানীয় উদ্যোক্তারাও ভয় পা্বে। তারাও বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবে না। তখন আমাদের যে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, তা আর অর্জিত হবে না। অর্থনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে।
Discussion about this post