‘নারীর মন আসলে কীসে আটকায়?’ এমন একটা প্রশ্ন করে পুরুষরা বেশ আয়েশে সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু উত্তর কি পাওয়া যাচ্ছে? ধরে নিলাম, নারীর মন অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সৌন্দর্য, জ্ঞান কোনো কিছুতেই আটকায় না। তাহলে পুরুষের মন কি আটকায়? পুরুষের মন আসলে কীসে আটকায়? আমি তো দেখি পুরুষের মন কোন কিছুতে আটকায় না। অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সৌন্দর্য, জ্ঞান কোনো কিছু পুরুষকেও আটকাতে পারে না। বরং সত্যি কথা বললে, নারীর চেয়ে পুরুষরা বেশি অস্থির। কোন কিছুই পুরুষকে অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিতে পারে না। নারীকেও পারে না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে নারীরা স্থির।
প্রশ্নটা আসলে অন্য জায়গায় তুলতে হবে।
ধরা যাক, দুজন পুরুষ খুব ভালো বন্ধু হয়েছেন। একজনের অর্থ প্রতিপত্তি ক্ষমতা সৌন্দর্য জ্ঞান অনেক বেশি। পুরুষ বন্ধু তার ক্ষমতা প্রতিপত্তির কিছু ভোগও করতে পারেন। যেভাবে নারী সঙ্গীও পুরুষ সঙ্গী অর্থ প্রতিপত্তি ক্ষমতার কিছু অংশ ভোগ করতে পারেন। পুরুষরাও নারী সঙ্গীত অর্ধ প্রতিপত্তি ক্ষমতা সৌন্দর্য ভোগ করতে পারেন। কিন্তু তাতে কি একজন ব্যক্তি মানুষ পরিতৃপ্ত হতে পারেন? যার ক্ষমতা যার অর্থ যার সৌন্দর্য সেটা তো তারই। একজন পুরুষ নারী সঙ্গীকে নিজের সম্পদ বিবেচনা করতে পারেন। একজন নারীও পুরুষ সঙ্গীকে নিজের সম্পদ বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুগে এসে সেটা চূড়ান্ত স্বস্তি দিতে পারে না। কারণ ব্যক্তি এখানে একক অস্তিত্ব। তার নিজস্ব মত আছে, ভালোলাগা মন্দলাগা আছে, পছন্দ অপছন্দ আছে। সম্পত্তি যদি কথা বলতে শুরু করে তবে আর মালিক শান্তিতে থাকতে পারে না।
ফলে শেষ পর্যন্ত সঙ্গীর সৌন্দর্যকে নারী পুরুষ সম্পত্তি মনে করলেও তা তাকে স্বস্তি দিতে পারে না।
ধরুন, আপনার পুরুষ বন্ধুর অনেক সম্পত্তি আছে। চাইলে তিনি আপনাকে না করেন না। কিন্তু সেটা আপনাকে সব সময় গর্বিত করবে না। আপনার মধ্যে ঈর্ষা জাগাবে। পুরুষ বন্ধুটি বন্ধুত্ব সত্ত্বেও আপনার ওপর নিজের মত চাপাবে, ভালো-মন্দ নির্দেশনা দেবে। ব্যক্তি হিসেবে এটা আপনি পছন্দ করবেন না শেষ পর্যন্ত। জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গ আপনার পছন্দ হলেও শেষ পর্যন্ত দেখবেন তাকে আপনার সহ্য হচ্ছে না। আপনি পদে পদে বুঝতে পারবেন বন্ধুটি আপনার চেয়ে বেশি জানে বোঝে বিশ্লেষণ করতে পারে। কিছুদিন অধীনতা মেনে নিলেও আপনি মন থেকে একটা সময় না একটা সময় বিদ্রোহ করবেন। ফলে ব্যক্তির নিজস্ব যে সম্পদ, তা সৌন্দর্য হোক আর টাকা হোক আর ক্ষমতাই হোক, শেষ পর্যন্ত এগুলোর ভিত্তিতে বন্ধুত্ব দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। এগুলো মানুষকে আটকাতেও পারে না। কী তাহলে আটকায় মানুষকে? এগুলো মানুষকে টানে কিন্তু মানুষকে আটকায় এইসব সম্পদের বাইরের কিছু জিনিস। যেমন শেয়ারিং। প্রত্যেক মানুষের ভেতর একাকীত্ব আছে, প্রত্যেক মানুষই মনে করে কেউ তাকে বুঝতে পারে না, তার যেখানে থাকার কথা সেখানে সে নেই, সে যা করতে চেয়েছিল তা করতে পারেনি, সে যা করতে চায় তা সে করতে পারছে না, তাকে নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যারা পরস্পরের মধ্যে এই জায়গাটা শেয়ার করতে পারে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রেম দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পরস্পরের প্রতি মায়া, পরস্পরের জন্য স্পেস, সময় এগুলো আসলে সম্পর্কের ভিত্তি। এই জায়গাগুলোতে যৌনতা ও চুম্বনের চেয়ে দম্পতিদের মধ্যে পরস্পরের হাতে হাত রাখার গুরুত্ব অনেক বেশি। কেউ ক্ষমতাশালী হতেই পারেন, তার মানে এই না যে সঙ্গীর হাতে হাত রাখতে হবে না তাকে। ক্ষমতাশালী সঙ্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে একজন জীবন পার করে দিতে পারবে।
কেউ অপূর্ব সুন্দরী হতে পারেন, কিন্তু এর মানে এই না যে সঙ্গীকে কেয়ার না করলেও তার চলবে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গী জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন।
তাৎক্ষণিক আকর্ষণ মিটে যাবার পর সারা জীবন ধরে মানুষ কমন যে বিষয়গুলো শেয়ার করে সেই আনন্দ বেদনা দুঃখ একাকীত্ব বঞ্চনার জগৎটাই মানুষকে এক করে রাখে।
কিন্তু মানুষের ট্র্যাজেডি হলো, আমরা যতই বলি কোনো মানুষই অন্য কোনো মানুষের প্রতি তার আগ্রহ মনোযোগ ও স্পৃহা বছরের পর বছর ধরে রাখতে পারে না। ফলে, তারা একজন ভালো সঙ্গীর সঙ্গে থাকতে থাকতেও আরো ভালো সঙ্গীর খোঁজ করতে থাকে। আসলে তারা সঙ্গীর খোঁজ করে না। নতুন মানুষের প্রতি আগ্রহ, মনোযোগ ও স্পৃহা তাদের নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে শেখায়। তারপর কিছুদিন চলে যাওয়ার পর তারা দেখে এটাও আরেকটা মানুষ। ফলে এই খোঁজ চলতে থাকে অন্তহীনভাবে।
ভালোবাসা প্রেম ও যৌনতার সহস্র কোটি ডলারের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে মানুষের এই অন্তহীন খোঁজের ওপর ভিত্তি করে।
এটা হয়তো মানুষের নিয়তিও। আমাদের অবচেতনে এই ধারণাটা হয়তো পোক্ত হয়ে আছে আমরা এই পৃথিবীতে অর্ধেক দেহে এসেছি। বাকি অর্ধেক দেহ পুরুষরা খুঁজে চলে নারীদের মধ্যে আর নারীরা খুঁজে চলে পুরুষের মধ্যে। নিজের দেহের প্রকৃত অপরাংশ কেউই কখনো খুঁজে পায় না।
এ এক অন্তহীন বাসনা।
এর কোন সমাধান নেই।
কোন শেষ নেই।
এ কারণেই যারা সমাজ গড়ে তুলেছেন ধর্ম গড়ে তুলেছেন তারা আমাদের শিখিয়েছেন যতটা সম্ভব স্থির হতে হবে।
একটা লেখা পড়েছিলাম। তাতে একজন নারী প্রশ্ন করেছিলেন পুরুষরা আসলে কীসে আটকায়? কোন ধরনের নারী তাদের কাছে আরাধ্য মনে হয়? কেমন ফিগার তাদের কাছে পারফেক্ট মনে হয়? কেমন গায়ের রং তাদের কাছে পছন্দসই মনে হয়? উত্তর মেলেনি। বোঝা যায়নি, পুরুষরা আসলে কী পছন্দ করে? কেন প্রায় সব পুরুষ নিজের সঙ্গীকে রেখে অপর নারীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে উত্তর মেলেনি। কেন মানুষ সঙ্গীকে ছেড়ে চলে যায়, তার সঠিক উত্তর মানুষ আসলে আন্তরিকভাবে দিতে পারে না। নিজেকে বিচার করে দিতে পারে না। সঙ্গীকে বিচার করে অবশ্যই দিতে পারে।
কিন্তু সবকিছুর পরও মানুষ একসঙ্গে থাকতে পারে। এর জন্য একজন ব্যক্তির নিজের যা আছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তাদের পরস্পরের যে সামান্য কমন সম্পত্তি আছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এরমধ্যে শীর্ষ সম্পত্তি হল মনোযোগ, শেয়ারিং আর সৌহার্দ্য।
Discussion about this post