ছবি : মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইট
১১ জন বাংলাদেশীর ওপর নিষেধাজ্ঞার যে গুজব ব্লিটজ পত্রিকাটির মাধ্যমে ছড়িয়েছে তা সত্য না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেকেই জানেন, পত্রিকাটির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা কাজ করে থাকে। খবরটি যদি সত্য নাও হয়, তবে স্বীকার করতে হবে পত্রিকাটি যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা সহকারে গুজব ছড়াতে পারে। তারা এমন এক সময়ে নিষেধাজ্ঞার খবরটি প্রচার করেছে যখন পরিস্থিতিগত কারণে অনেকেই বিশ্বাস করতে বাধ্য এমন একটি ঘটনা ঘটতেও পারে। এই খবরটি প্রচারিত হওয়ার তিনদিন আগে বাংলাদেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রভাবশালী এস আলম গ্রুপের দুর্নীতি ও অর্থপাচার নিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন প্রচার করেছে। এবং খবরটি প্রকাশের একদিন আগে রিচার্ড নেফিউয়ের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্নীতি দমন ও অর্থপাচার বিষয়ক তিনজনের একটি টিম বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। রিচার্ড নেফিউ একজন নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আরো একটি নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে একটি গুজব ঢাকার বাতাসে ছড়ানোই ছিল। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ব্লিটজের খবরটি খুব যুতসই হয়েছে। পত্রিকাটির অতীত উদাহরণ মাথায় রেখে যারা খবরটি বাতিল করার চেষ্টা করছেন তারাও মনে মনে হয়তো বিশ্বাস করতে চাইছেন এমন একটি ঘটনা ঘটতেই পারে। খবরটি মিথ্যা হলেও গত কয়েক দিনে দুর্নীতি দমন কমিশন ঘিরে রিচার্ড নেফিউয়ের তৎপরতায় এটা স্পষ্ট, তারা সম্ভবত বাংলাদেশের কতিপয় অর্থ পাচারকারীকে টার্গেট করেছেন। বাংলাদেশ থেকে টাকা তারা কোন পথে কোথায় নিয়েছেন এ বিষয়গুলো বুঝতে চেষ্টা করছেন। অথবা বুঝে ফেলার পর কনফার্ম হতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এটা কৌশলগতভাবে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত একটি পদক্ষেপ। তারা যদি বাংলাদেশে চীনের প্রভাব মোকাবেলা করতে চায় তবে ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপকে টার্গেট করতে পারে। হতে পারে, এই ব্যবসায়ীরা চীনের সঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি সহ নানা বড় ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত অথবা চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত না হলেও সরকারকে চীনা পদ্ধতি অনুসারে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালিয়ে যেতে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন। অর্থপাচার এক্ষেত্রে মোক্ষম অস্ত্র। এর মাধ্যমে সম্ভবত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপকে কাবু করা সম্ভব।
এই দিক থেকে বিবেচনা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব স্মার্ট একটা মুভ নিয়েছে। নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট ধারণা আছে। সেটা পূরণ করতে তারা একের পর এক কাজ ধারাবাহিকভাবে করে যাবে। তাদের পদক্ষেপের একটা অংশ বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেটা চূড়ান্ত টার্গেট নয় বলেই মনে হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পরও তাদের কাজ থেমে থাকবে না। তাদের কার্যক্রমের মাঝপথে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে যে পদক্ষেপগুলো নিতে যাচ্ছে সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন আছে। জনসমর্থনহীন আওয়ামী লীগ সরকার এ ধরনের কোনো আলাপ-আলোচনা করতে পারবে না তা স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের মূল লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। এজন্য তারা দক্ষিণ এশিয়ার বোকা মাতবর ভারতের দারস্থ হলেও প্রকৃতপক্ষে চীনের ওপরেই নির্ভরশীল। তাদের লক্ষ্য, যেকোনো মূল্যে একটি নির্বাচন করা এবং নির্বাচনের পর কর্তৃত্ববাদের মাত্রা বাড়িয়ে চীনা সমর্থনে বার্মার জুন্টা মডেল কাজে লাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত রাখা। এই কাজে তারা সফল হতেও পারে। মার্কিনিদের দিক থেকে নানা চাপ সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের গতিবিধি সরকারকে এক ধরনের স্বস্তির মধ্যে রেখেছে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের পর আন্দোলন যেভাবে স্থিমিত হয়ে পড়েছিল এবারও সেভাবে আন্দোলনের গতি উঠতে উঠতে ২৮ জুলাইয়ের বড় সমাবেশের পর আবারো আন্দোলন স্থিমিত হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। যেকোনো কারণেই হোক, বিএনপি আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারছে না। তারা খুব সম্ভবত এখন ইলেকশনের তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলন জোরদার করার কথা ভাবছে। এ ভাবনাটি আত্মঘাতী হতে বাধ্য। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে জনগণ আরো বেশি বিক্ষুব্ধ হতে পারে কিন্তু হতাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, তফসিল ঘোষণার পর সরকার যদি ১০০ আসন ছেড়ে দেওয়ার অফার নিয়ে ছোট বড় দল গুলোর নেতাদের টোপ দিতে শুরু করে তবে উকিল আব্দুস সাত্তারের মতো করে অনেকেই আগ্রহী হবেন। বিশেষ করে জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন এরকম অফার ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এরকম আরো নানা দল আছে। ফলে তফসিল ঘোষণার পর জোরদার আন্দোলনের চিন্তা হালে পানি পাবে না। আর একবার তফসিল ঘোষণা করে ফেলতে পারলে নির্বাচন করে সরকার গঠন করার এবং সে সরকার টিকিয়ে রাখার যথেষ্ট সামর্থ্য এখনো আওয়ামী লীগের আছে। নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টাও সফল হবে বলে মনে হয় না।
তবে এমন একটি নির্বাচন করে ফেলার পর আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের সহযোগীরা নানা রকম নিষেধাজ্ঞা ও চাপে পড়বে। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের নেতৃত্বও তাদেরকে দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের আরও বেশি করে চীনের বলয়ের মধ্যে যেতে হবে। বার্মা মডেল আত্মস্থ করা ছাড়া আওয়ামী লীগের সামনে আর কোনো উপায় থাকবে না। এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হলে কৌশলগতভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংগত কারণেই এমন একটি পরিস্থিতি চাইবে না। তারা সরকারকে নানাভাবে বোঝানোর রাস্তায় আছে। আওয়ামী লীগেরও হয়তো বোধোদয় হবে। কেননা, আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ সঙ্গীসাথী চাইবে না বাংলাদেশ পাকাপোক্তভাবে
পশ্চিমা বলয় থেকে বের হয়ে এসে চীনের বলয়ে ঢুকে পড়ুক। আওয়ামী লীগের এই শুভানুধ্যায়ীরা হয়তো দলটিকে বোঝাতে সক্ষম হবে যে আরেকটি একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশকে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে।
অনেকেই মনে করেন, বিএনপি হয়তো অতিমাত্রায় পশ্চিমানির্ভর হয়ে পড়েছে। তারা হয়তো শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা বুঝতে পারেন না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে বিএনপির মতো একটি উদারপন্থী জনপ্রিয় দলের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে।
তবে যে যার দিকেই তাকিয়ে থাকুক, বিএনপিকে এখন জনগণের দিকে তাকাতে হবে। জনগণের মুখের ভাষা পড়ে যদি তারাও উপযুক্ত কর্মসূচি দিতে না পারে, যদি আবারও সিদ্ধান্তহীনতা ও দোদুল্যমানতা তাদের আক্রান্ত করে তবে বাংলাদেশের আসন্ন বিপর্যয়ের দায়ভার তাদের ওপরেও বর্তাবে।
Discussion about this post